
সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ থেকে সরকারি হাইস্কুল শিক্ষকদের চাকরি বিধামালার গেজেট জারি করা হয়। তাতে ‘সিনিয়র শিক্ষকে’র নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। সহকারী শিক্ষকের মোট পদের ৫০ ভাগ পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ করার কথা বলা হয়েছে। ‘সিনিয়র শিক্ষক’ পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে সহকারী শিক্ষক পদে অন্তত আট বছর চাকরি করতে হবে। সহকারী শিক্ষক পদে চাকরিতে প্রবেশের পাঁচ বছরের ব্যাচেলর অব অ্যাডুকেশন (বিএড) বা ডিপ্লোমা ইন অ্যাডুকেশন (ডিপ ইন অ্যাডু) বা ব্যাচেলর অব এগ্রিকালচার অ্যাডুকেশন (বি এজ অ্যাডু) ডিগ্রি থাকতে হবে। নানা কারণে অনেক শিক্ষক এই শর্তটি নির্ধারিত সময়ে অর্জন করতে পারেননি। এই শর্ত অর্জন না করা প্রায় দেড় হাজার শিক্ষককে পদোন্নতির তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। অর্ধ কোটি টাকা লেনদেনের অভিযোগ করে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) শিক্ষকরা অভিযোগ করেছেন।
সূত্র জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক-১) নাজমুল হক খানের সভাপতিত্বে গত ১০ ফেব্রুয়ারি পাঁচ সদস্যের পদোন্নতি কমিটির সভা হয়েছে। তাতে অভিযোগ নিষ্পত্তি হয়নি। শিক্ষক নেতারা বলেছেন, পদোন্নতি পেতে হলে নিয়োগ বিধির শর্ত পূরণ করতে হবে। কিন্তু মাউশির একটি অংশ এই শর্ত মানতে রাজি নয়। তারা সহকারী শিক্ষক পদে যোগদানের তারিখ থেকে পদোন্নতির হিসাব করে পদোন্নতি দিতে চান।
জানতে চাইলে মাউশির মহাপরিচালক প্রফেসর ড. সৈয়দ গোলাম ফারুক বলেন, এখন পর্যন্ত ডিপিসিতে (বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটি) পদোন্নতি চূড়ান্ত হয়নি। পদোন্নতি চূড়ান্ত করতে আরো সময় লাগবে। নীতিমালা লঙ্ঘন করে পদোন্নতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ডিপিসিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি রয়েছে। তাদের পাশ কাটিয়ে পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ নেই। যোগ্য কোনো শিক্ষক তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হবেন না।
জানা গেছে, শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের দাবীর প্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে সরকারি হাইস্কুলে কর্মরত মোট পদের ৫০ শতাংশ পদ সিনিয়র শিক্ষক অর্থাৎ প্রথম শ্রেণির নন ক্যাডার পদ সৃষ্টি করা হয়। এরপর পদোন্নতির প্রক্রিয়া অনেকটাই গুছিয়ে এনেছিল মাউশি। ওই বছরের ২৭ অক্টোবর সহকারী শিক্ষকদের পদোন্নতি দিতে খসড়া গ্রেডেশন তালিকা প্রকাশ করে। এ তালিকায় পাঁচ হাজার ৮৫৪ শিক্ষকের নাম ছিল। তালিকার অসঙ্গতি বা আপত্তি থাকলে ওই বছরের ১৪ নভেম্বরের মধ্যে আবেদন পাঠাতেও বলা হয়েছিল শিক্ষকদের। কিন্তু নীতিমালা নিয়ে কতিপয় শিক্ষক আপত্তি তুললে আটকে যায় সে প্রক্রিয়া। পরে সিনিয়র শিক্ষক পদে পদোন্নতি দিতে বিকল্প কয়েকটি প্রস্তাব দিয়ে শিক্ষকদের গ্রেডেশন তালিকা পাঠায় মাউশি।
সূত্র জানায়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশির মতামতের ভিতিতে সিনিয়র শিক্ষক পদে পদোন্নতির জন্য জেষ্ঠতা সমস্যা নিরসনে গত ২০১৯ সালের ৮ সেপ্টেম্বর চূড়ান্ত আদেশ দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তখন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সিন্ধান্ত দিয়ে বলেছিল কৃষি শিক্ষকদের জেষ্ঠতা তাদের ১০ গ্রেডে উন্নীত করার তারিখ অর্থাৎ ২০০৪ সালের ২২ মে থেকে কার্যকর হবে। কিন্তু এটি চ্যালেঞ্জ করে কৃষি শিক্ষকেরা প্রশাসনিক ট্রাইবনালে মামলা করলে পদোন্নতি আটকে যায়। মাউশি সূত্র জানায়, বিশেষ প্রক্রিয়ায় ১৯৯৫ সালে ৩৭৮ জন কৃষি শিক্ষক নিয়োগ পেয়ে ছিলেন ১৪তম গ্রেডে। তাই তারা সে সময় ১৪তম গ্রেডে বেতন পেতেন। আর অন্য শিক্ষকরা পেতেন ১০ম গ্রেডে বেতন।
মাউশির দেওয়া তথ্যানুযায়ী, সদ্য জাতীয়করণসহ সারাদেশে বর্তমানে ৫৩১টি সরকারি হাইস্কল রয়েছে। এর মধ্যে পুরাতন সরকারি হাইস্কুলের সংখ্যা ৩১৭টি। নতুন সরকারি করা অনেক স্কুলে পদসৃজন হয়নি। পুরাতন ৩০০টি স্কুলে প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে। আর জেলা শিক্ষা অফিসারের পদ শূন্য রয়েছে ৩৩টি। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর ৪২০ জন সহকারী শিক্ষককে সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এরমধ্যে সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে ৩৬৮ জন ও সহকারী জেলা শিক্ষা শিক্ষা কর্মকর্তা পদে ৫২ জনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এ পদোন্নতির পর বর্তমানে সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে ১৪০টি। বর্তমানে সরকারি হাইস্কুলে ৮ হাজারের মতো শিক্ষক কর্মরত আছেন। আর বিভিন্ন পদ মিলিয়ে শূন্য রয়েছে আড়াই হাজার। শূন্য পদে ১ হাজার ৯৯৯টি পদে সরাসরি নিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহাব উদ্দীন মাহমুদ সালমী বলেন, যেহেতু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সিনিয়র শিক্ষক পদে পদোন্নতি দিতে সুষ্পষ্ট মতামত দিয়েছে। সুতরাং তারই আলোকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রায় ৫ হাজার সহকারি শিক্ষকের পদোন্নতি দিতে পারে। এক্ষেত্রে সরকারের পদক্ষেপ যেমন বাস্তবায়ন হবে পাশাপাশি ৩০ বছর ধরে পদোন্নতি না পাওয়া শিক্ষকেরা পদোন্নতি পেয়ে অবসরে যেতে পারবেন।
মাউশি সূত্র জানায়, সরকারি হাইস্কুল শিক্ষকদের পদোন্নতির নীতিমালা অনুযায়ী ২০১০ সাল পর্যন্ত বিএড ডিগ্রি অর্জনের দিন থেকে জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করা হয়। চাকরিতে যোগদানের দিন থেকে জ্যেষ্ঠতা নির্ধারিত হতো না। চাকরিতে যোগদান করে নবীন শিক্ষকরা বিএড করে দ্রুত পদোন্নতি পেতেন। চাকরির যোগ্যতা হিসেবে বিএড ডিগ্রি বাধ্যতামূলক না থাকায় বঞ্চিত হন বিএড না করা প্রবীণ শিক্ষকরা।
জানা গেছে, বঞ্চিত শিক্ষকদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালে নীতিমালাটি সংশোধন করা হয়। নতুন নীতিমালায় চাকরিতে যোগদানের দিন থেকেই জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করা হয়। তবে বিএড ডিগ্রি বাধ্যতামূলক ছিল। নতুন নীতিমালা চ্যালেঞ্জ করে ৭৫ জন সহকারী শিক্ষক ২০১৫ সালের মার্চে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন। ওই বছরের ৭ ডিসেম্বর রিটের রায় দিয়েছেন আদালত। তাতে বলা হয়, ২০১০ ও ২০১১ সালের পদোন্নতি নীতিমালাটি সাংঘর্ষিক। ২০১০-এর পদোন্নতি নীতিমালা অনুযায়ী জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণের মতামত দিয়েছেন আদালত। এই রায়ের বিরুদ্ধে শিক্ষকরা আপিল করেন। ২০১৭ সারের ৯ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট চূড়ান্ত রায় দিয়েছেন। এর আগে মামলা জটিলতায় ২০১৪ সালের ৬ জুন থেকে সরকারি হাইস্কুলের শিক্ষকদের পদোন্নতি বন্ধ ছিল। ২০১৭ সালের ৯ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট পদোন্নতির বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে রায়ে বলেছেন, চাকরিতে যোগদানের তারিখ থেকে জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করে পদোন্নতি দিতে হবে। তবে ১০ম গ্রেডসহ অবশ্যই বিএড বা সমমান ডিগ্রি থাকতে হবে। পরে ওই রায়ের প্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ৪২০জন সহকারী শিক্ষককে সহকারী প্রধান শিক্ষক ও সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসার পদে পদোন্নতি দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এখন নতুন নিয়োগ বিধি হওয়ায় সিনিয়র শিক্ষক থেকে সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি কিভাবে হবে এ বিষয়ে কোনো বিধি সংশোধন হয়নি।