
কলব মানে আত্মা-অন্তর। কোনো কিছুর খাঁটি ও সেরা অংশকে বলা হয় কলব বা আত্মা-প্রাণ। প্রাণ বা আত্মার নাম কলব রাখা হয়েছে, কারণ তা মানুষের উচ্চ ও উৎকৃষ্টতম অঙ্গ। আত্মা হলো আল্লাহর শ্রেষ্ঠ ও উৎকৃষ্টতর সৃষ্টি। এর ভ‚মিকা অনুভ‚তিতে প্রকাশ্যে হয় না। এটি বরং রুহ, নফস, মস্তিষ্ক, হৃদয় ও জ্ঞানের মতো অদৃশ্য জগতের অংশ। এগুলো সব আল্লাহর দান, যা অনুভ‚তির জগৎকে উদ্ভাসিত করে। আল্লাহর অনুমতিতে তাকে দেয় সাহায্য, খোরাক ও আলো। যে আলো ও সহায়তা প্রভেদ সৃষ্টি করে সত্য ও মিথ্যার মাঝে, সৎ ও অসতের মাঝে, উপকারী ও অপকারীর মাঝে এবং বাস্তবতা ও কল্পনার মাঝে।
নুমান বিন বাশির (রা.) সূত্রে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘জেনে রেখো, নিশ্চয়ই মানবদেহে রয়েছে একটি মাংসপিণ্ড সেটি সুস্থ থাকলে পুরো দেহ সুস্থ থাকে আর সেটি বিনষ্ট হলে পুরো দেহ নষ্ট। সেটি হলো কলব বা আত্মা।’ (বোখারি ও মুসলিম)।
আত্মা সুস্থ থাকে ইমান, বাস্তবতার পরিচয় ও অবস্থার অবগতির মাধ্যমে। আর শরীর সুস্থ থাকে আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্য দ্বারা। হৃদয় যখন শিরক, কুফর এবং আত্মগর্ব, আত্মতুষ্টি, লৌকিকতা ও হিংসা প্রভৃতি হƒদয়ঘটিত অপকর্ম দিয়ে দূষিত হয়, দেহও তখন গোনাহ, অবাধ্যতা, সৃষ্টির প্রতি জুলুম ও পৃথিবীতে অনাচারের মাধ্যমে অসুস্থ হয়ে পড়ে। কলব মিলন ও গ্রহণের স্থান। এটি মানুষের অভ্যন্তর এবং বাইরের কর্ম ও আচরণের মাঝে সেতু। রাসুলুল্লাহ (সা.) বারবার এ দোয়া করতেন : ‘হে অন্তরগুলোর পরিবর্তনকারী! আমার অন্তরকে তোমার দ্বীনের প্রতি অবিচল রাখ।’ সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল, আপনি কি আমাদের ব্যাপারে ভয় করছেন অথচ আমরা আপনার ও আপনার আনীত দ্বীনের প্রতি ইমান এনেছি? তিনি (সা.) বললেন, সব অন্তর আল্লাহর? আঙ্গুলগুলোর দুই আঙ্গুলের মধ্যে অবস্থিত। তিনি নিজের আঙ্গুল দিয়ে সেগুলো যেভাবে ইচ্ছা ঘুরিয়ে থাকেন।’ (বর্ণনায় আহমাদ)। নবী (সা.) কলব-অন্তর শব্দ দিয়ে এভাবে কসমও করতেন : ‘শপথ অন্তর পরিবর্তনকারীর।’ (বর্ণনায় বোখারি)।
কলব বা হৃদয় হলো সমূহ কল্যাণের আধার। কলবের সঙ্গে কল্যাণ শব্দটি যুক্ত হয়ে এসেছে আল্লাহর বাণীতেও : ‘আল্লাহ যদি তোমাদের অন্তরে কোনো রকম মঙ্গলচিন্তা রয়েছে বলে জানেন; তবে তোমাদের তার চেয়ে বহুগুণ বেশি দান করবেন, যা তোমাদের কাছ থেকে বিনিময়ে নেওয়া হয়েছে। তাছাড়া তোমাদের তিনি ক্ষমা করে দেবেন। বস্তুত আল্লাহ ক্ষমাশীল, করুণাময়।’ (সূরা আনফাল : ৭০)। অতএব যে হৃদয়ে মঙ্গল রয়েছে, তা পরিমাণে যত কম হোক না কেন, সেটি ইমানের জন্য উš§ুক্ত হবেই। আল্লাহ তায়ালার এ বাণীতে একটু লক্ষ করুন : ‘তাদের অন্তরে আল্লাহ ইমান লিখে দিয়েছেন এবং তাদের শক্তিশালী করেছেন তাঁর অদৃশ্য শক্তি দ্বারা।’ (সূরা মুজাদালা : ২২)। আল্লাহ শানুহু আরো বলেন : ‘কিন্তু আল্লাহ তোমাদের অন্তরে ইমানের মহব্বত সৃষ্টি করে দিয়েছেন এবং তা হৃদয়গ্রাহী করে দিয়েছেন।’ (সূরা হুজুরাত : ৭)।
কলবের রয়েছে কিছু বিশেষ আমল, যা ভাবনা-অনুভ‚তি ও অবস্থার রূপান্তরে প্রকাশ পায়। যথা ভালোবাসা-আনন্দ, ভাবনা-চিন্তা, অস্থিরতা-ক্রোধ, হিংসা-বিদ্বেষ, অভিসার-চক্রান্ত, বুঝ, সজাগতা ও জ্ঞানের মতো বান্দার বিবিধ কর্মকাণ্ড। যেমনটি আল্লাহ শানুহু কিছু লোক সম্পর্কে বলেছেন : ‘তাদের অন্তর রয়েছে, তার দ্বারা বিবেচনা করে না।’ (সূরা আরাফ : ১৭৯)।
অন্তরের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্ববহ আমল নিয়ত বা সংকল্প। নিয়ত হলো হৃদয় যাতে স্থির হয় এবং যার সংকল্প করে। সহিহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে : ‘নিশ্চয়ই কাজের ফলাফল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। আর প্রত্যেক ব্যক্তির তাই প্রাপ্য, যার নিয়ত সে করে।’ (বর্ণনায় বোখারি ও মুসলিম)।
নিয়ত হলো ইবাদতের মজবুত ভিত। অভ্যাস থেকে ইবাদতকে আলাদা করে এ নিয়ত। ইবাদতের একটি থেকে আরেকটিকেও আলাদা করে নিয়ত। এটি বরং আদতকেও ইবাদত বানিয়ে দেয়। নিয়তের অশুদ্ধি ইবাদতকে শুদ্ধ বানায়। আর ইখলাস হলো এ নিয়তের সততা ও আত্মার অপরিচ্ছন্নতা।
অন্তরের আরেকটি আমল অবিচলতা। এটি তৈরি করে ব্যক্তিত্ব ও স্থিরতা। বান্দাকে যখন অবিচলতা দান করা হয় এটি তাকে অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা থেকে রক্ষা করে। তাকে এমন বানায় যে সে বাস্তবতা অনুধাবন করে এবং কাজ করে ভবিষ্যতের লক্ষ্যে। নবী (সা.) মুয়াজ (রা.) কে ইয়েমেনে প্রেরণকালে বলেন, ‘আল্লাহ তোমার অন্তরকে অবিচল করবেন এবং তোমার মননকে পথ দেখাবেন।’ (বর্ণনায় আহমাদ, আবু দাউদ ও তিরমিজি)।
আত্মার রয়েছে আরো কিছু মহৎ গুণ, যা ইমানের অন্দর-বাহিরকে তুলে ধরে। এতে দীপ্ত হয় আত্মার প্রাণ ও দান এবং বান্দার অবিচলতা ও সুস্থতা। এসব বৈশিষ্ট্যের একটি সুস্থ আত্মা। যেমন আল্লাহ বলেছেন : ‘যেদিন ধনসম্পদ ও সন্তানসন্ততি কোনো উপকারে আসবে না; কিন্তু যে সুস্থ অন্তর নিয়ে আল্লাহর কাছে আসবে।’ (সূরা শুআরা : ৮৮-৮৯)। অনুরূপ নবী (সা.) এর একটি দোয়া ছিল এমন : ‘হে আল্লাহ, আপনার কাছে চাই সুস্থ অন্তর।’ (বর্ণনায় আহমাদ, তিরমিজি ও নাসায়ি)।
সুস্থ অন্তর সেটিই, যা কপটতা, সংশয়, শিরক, মন্দ ও ভ্রষ্টতা থেকে মুক্ত। এর বাহ্যও তেমন, অভ্যন্তরও যেমন। এর ভেতরের কথাই বলে এর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। সুস্থ আত্মা সমন্বয় ঘটায় মাবুদের জন্য নিষ্ঠা এবং ভক্তিসহ তার জন্য চেহারা সমর্পণের মাঝে। আল্লাহর শরিয়তের অনুসরণ করে খাঁটি ও সমর্পিত হয়ে। আল্লাহ বলেন : ‘হ্যাঁ, যে ব্যক্তি নিজেকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে সমর্পণ করেছে এবং সে সৎকর্মশীলও বটে তার জন্য তার পালনকর্তার কাছে পুরস্কার বয়েছে। তাদের ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না।’ (সূরা বাকারা : ১১২)।
আত্মা তখনই সুস্থ হয়, যখন তা আল্লাহকে চেনে, তাঁর আনুগত্য করে, তাঁকে ভয় করে, তাঁর সীমারেখার মধ্যে অবস্থান করে এবং খাদ্য, পানীয় ও পোশাক শুদ্ধ হয়। বস্তুত যার কাছে তার দ্বীনের বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, যে অলসতার নিদ্রা থেকে সজাগ এবং আখেরাতে মুক্তির প্রত্যাশী, সে প্রচণ্ডভাবে নিজের আত্মাকে সুস্থ রাখতে সচেষ্ট থাকে। বেঁচে থাকে নফসের পতন ও ধ্বংসের পথ-পন্থা থেকে। হাসান বসরি (রহ.) বলেন, ‘জেনে রেখো, তুমি সত্যিকারার্থে আল্লাহকে ভালোই বাসলে না, যতক্ষণ না তাঁর আনুগত্যকে ভালোবাস।’
Array