
দেশের প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেছেন, টিকা নেয়ার তিন সপ্তাহ পর শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়। এর আগে শরীরে করোনা ভাইরাস প্রবেশ করলে তা পূর্ণ ক্ষমতায় আক্রমণ করতে পারে। সঙ্গে তার যদি অন্য কোনো রোগ থাকে তাহলে শারীরিক অবস্থা খারাপ হয়ে যেতে পারে।
অবশ্যই এর প্রমাণও মিলেছে দেশে। করোনার টিকা নেয়ার পরও হচ্ছে না মানুষের শেষ রক্ষা। টিকা নিয়েও করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন একের পর একজন। এমনকি টিকা নেয়ার এক মাস পর গত বৃহস্পতিবার করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন সিলেট-৩ আসনের সংসদ সদস্য মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী কয়েস।
প্রশ্ন উঠেছে টিকা নেয়ার পরেও কেন করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষ? তবে ডা. এবিএম আব্দুল্লাহসহ দেশের খ্যাতিমান চিকিৎসকরা বলছেন, অন্য সব টিকার তুলনায় করোনার টিকার প্রকৃতি ভিন্ন। সুরক্ষার জন্য এই টিকা নিতে হবে দুটি। আর তাতেও শতভাগ সুরক্ষা মিলবে এমন নয়। বাংলাদেশ যে টিকা এনেছে সেটি প্রথম ডোজের পর ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ কার্যকর বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। আর দ্বিতীয় ডোজ দিলে সেটি ৯০ শতাংশ হতে পারে। তাই করোনার টিকা নিলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। না হলে ভয়াবহ বিপদ নেমে আসতে পারে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, সিলেট-৩ আসনের সংসদ সদস্য মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী কয়েস গত ১০ ফেব্রুয়ারি সংসদ সচিবালয় ক্লিনিক থেকে করোনা প্রতিরোধ টিকা নিয়েছেন। টিকা নেয়ার এক মাস পর গত ১১ মার্চ বৃহস্পতিবার করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এছাড়াও টিকা নেয়ার এক মাস পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) রুহুল আমিন চৌধুরী, ১২ দিন পর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোহসীন, টিকা নেয়ার ২৭ দিনের মাথায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম, টিকা নেয়ার এক সপ্তাহ পর নন্দিত পরিচালক ও অভিনেতা কাজী হায়াৎসহ আরো অনেকে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।
ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, বিশ্বে যেসব টিকা দেয়া হচ্ছে, সেটির কোনোটিই ১০০ ভাগ সুরক্ষা দেয় না। সর্বোচ্চ ৯৫ শতাংশ সুরক্ষা দিতে পারে ফাইজারের টিকা। সেটিও দ্বিতীয় ডোজ দেয়ার পরে। তবে এই টিকা রাখার মতো অবকাঠামো বাংলাদেশের নেই। এটি সংরক্ষণ করতে হয় মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।
টিকা নিয়েও গুরুত্বসহকারে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বাইরে গেলে অবশ্যই মাস্ক পরে যেতে হবে। বারবার সাবান পানি দিয়ে হাত ধুতে হবে। কিন্তু মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। শারীরিক দূরত্বও মানা হচ্ছে না।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, টিকা নেয়ার পরও মানুষ করোনায় সংক্রমিত হতে পারেন। এই বিষয়টি টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগেও দেখা গেছে। আমাদের মনে রাখতে হবে- করোনার টিকা নিলে করোনা হবে না এই কথা কোনো টিকা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানই বলে নাই। এছাড়াও টিকার এক ডোজ পুরোপুরি কাজ করবে না. দুই ডোজ দিতে হবে।
রোগতত্ত্বা, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন মানবকণ্ঠকে বলেন, করোনার টিকা ৭০ ভাগ কাজ করবে। অর্থাৎ ১০০ জন মানুষ টিকা নিলে ৭০ জনকে কাজ করবে। বাকিদের কাজ না করতে পারে। দ্বিতীয়ত, করোনার টিকা নিলে সংক্রমিত হবেন না- এমন টিকা এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। তবে টিকা নিলে সেটার গ্যারান্টি হচ্ছে, টিকা নেয়ার পর গুরুতর কোনো অসুস্থতা হবে না।
তিনি বলেন, আমাদের টিকা নেয়ার পর দুই বছর পর্যন্ত তাদের পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। তাদের দেহে কি ধরনের অসুবিধা হচ্ছে? ফের তাদের টিকা নিতে হবে কিনা। এজন্য আমরা সবসময়ই বলছি টিকা নেয়ার আগে পরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, টিকা নেয়ার তিন সপ্তাহ পরে প্রতিরোধ ক্ষমতা শরীরে তৈরি হয়। আর দুই সপ্তাহে খুব কম তৈরি হয়। যদি এর মধ্যে করোনা শরীরে ঢুকে থাকে তাহলে সেটি বিস্তার লাভ করবে এবং তা মারাত্মক হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, অনেকের শরীরে মারাত্মক কিছু রোগের উপস্থিতি থাকে ফলে কখনো কখনো টিকা কোনো কাজ করে না। এই বিষয়টি কিন্তু বিজ্ঞান স্বীকৃত। যে কারণে টিকা নিয়ে মারা গেছেন- বিষয়টি এ রকম না। যদি কেউ টিকা নেয় এবং তার এক সপ্তাহের মধ্যেও তার শরীরে করোনা ভাইরাস প্রবেশ করে তাহলে সেই ভাইরাস কিন্তু তাকে পূর্ণ ক্ষমতায় আক্রমণ করতে পারে। সঙ্গে তার যদি অন্য কোনো রোগ থাকে তাহলে শারীরিক অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে।
তিনি আরো বলেন, এখন বেশি সংখ্যক লোক যদি মনে করে আমি টিকা নিয়েছি, আমার আর করোনা হবে না। আমার মধ্যে করোনা প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়েছে আমার আর স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে না। এটি হলে চলবে না। আমরা বলছি টিকা নেয়ার পর মাস্ক পরতে হবে, স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। তবে দ্বিতীয় ডোজ নেয়ার দুই সপ্তাহ পর পূর্ণ সক্ষমতা তৈরি হবে। তখন যারা টিকা নিয়েছেন তারা একত্রিত হলে মাস্ক না পরলেও চলবে।
ফের বাড়ছে সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা: এদিকে চলতি মাসের শুরু থেকেই দেশে ফের বাড়তে শুরু করেছে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা। যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি না মানলে সংক্রমণ আরো বাড়তে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১৩ জন। এখন পর্যন্ত মারা গেছেন আট হাজার ৫১৫ জন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারিতে দেশে দৈনিক শনাক্তের হার দুই দশমিক ২৬ থেকে তিন দশমিক ৩০ শতাংশের মধ্যে থাকলেও চলতি মাসে তা বেড়ে পাঁচ শতাংশ ছাড়িয়েছে। দেশব্যাপী টিকাদান কর্মসূচি চলছে এবং চলতি মাসের শেষের দিকে খোলা হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তবে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি গতকাল বলেছেন, এভাবে সংক্রমণ বাড়লে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা নাও হতে পারে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, মানুষজন সামাজিক দূরত্ব মানছেন না এবং মাস্ক পরছে না। সে কারণেই এখন সংক্রমণের হার বেশি। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। এটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। ‘আমরা পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। আর লোকজনের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, তারা পেছনে ফিরে যেতে চায়। যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপে কী ঘটেছে তা আমরা দেখতে চাই না। সামাজিক ও রাজনৈতিক সমাবেশ সীমিত করতে আমরা ইতোমধ্যে দেশব্যাপী ডিসিদের নির্দেশনা পাঠিয়েছি। শিগগিরই স্বাস্থ্যবিধি মানার আহ্বান জানিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রচার করা হবে বলেও জানান তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশিদ আলম বলেন, ‘মানুষের অসতর্কতা সত্যিই হতাশাব্যঞ্জক। ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ নেয়ার পর অনেকেই ভাবছেন তারা এখন নিরাপদ। কিন্তু, বিষয়টি তো তেমন নয়। যদি মানুষ বিপদ সম্পর্কে সচেতন না থাকে, তাহলে আমাদের কী করার আছে?।
শুক্রবার দুপুরে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে দেয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় অ্যান্টিজেন ও আরটি-পিসিআর পদ্ধতিতে মোট ১৬ হাজার ১১১টি নমুনা পরীক্ষা করে করোনায় আক্রান্ত আরো এক হাজার ৬৬ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ছয় দশমিক ৬২ শতাংশ। এ নিয়ে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে পাঁচ লাখ ৫৫ হাজার ২২২ জনে দাঁড়াল।
বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়া ১৩ জনের মধ্যে ১২ জন পুরুষ ও একজন নারী। বয়সভিত্তিক বিশ্লেষণে তাদের মধ্যে একজনের বয়স ৩১-৪০ বছরের মধ্যে, তিনজনের বয়স ৪১-৫০ বছরের মধ্যে, দুই জনের বয়স ৫১-৬০ বছরের মধ্যে ও ষাটোর্ধ্ব রয়েছেন সাতজন। ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন আরো এক হাজার ২৫২ জন। এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন পাঁচ লাখ নয় হাজার ১৭২ জন। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত ৪২ লাখ ৩২ হাজার ১৩৯টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরো জানানো হয়, দেশে মোট পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ১২ শতাংশ। আর মোট শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৯১ দশমিক ৭১ শতাংশ ও মৃত্যুর হার এক দশমিক ৫৩ শতাংশ।
Array