
পাঠাও কেন আপনার কনটাক্ট লিস্ট এবং ম্যাসেজগুলো চুরি করে?
সংক্ষিপ্ত উত্তরঃ আপনার মোবাইলে জনপ্রিয় রাইড শেয়ারিং সার্ভিস পাঠাও ইন্সটল করার সাথে সাথে এপটি আপনার মোবাইলের কনটাক্ট লিস্ট, সব ম্যাসেজ, আপনার মোবাইলে কি কি এপ ইন্সটল করা আছে সব চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। আশিক ইশতিয়াক ইমন নামের একজন মোবাইল এপ ডেভেলাপার একটি ভিডিও বার্তার মাধ্যমে পাঠাও সার্ভিসের এই কুকীর্তি ফাঁস করে দিয়েছেন। পাঠাও কর্তৃপক্ষ এই অভিযোগ স্বীকার করে নিয়ে বলেছে যে তারা আপনার কনটাক্ট লিস্ট এবং যাবতীয় ম্যাসেজ তাদের সার্ভারে স্টোর করে রাখে। প্রশ্ন হল কেন তারা এটা করছে?
পাঠাও কি থার্ড পার্টির কাছে ভোক্তাদের ইনফর্মেশন বেচে কোন ধরণের টাকা কামানোর ধান্ধা করছে? নাকি তাদের আরো বড় কোন ধরনের উদ্দেশ্য আছে? এই বিষয় সম্পর্কে ধারণা পেতে পাঠাও কোম্পানির ব্যবসা, তাদের গোল এবং বর্তমানের বিশ্বের আলোচিত বিষয় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্ট (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) ও ব্যবসায় তার ব্যবহার সম্পর্কে আলোচনা করে নেওয়া দরকার।
পাঠাও বাংলাদেশের সবচেয়ে সাকসেসফুল স্টার্টআপগুলোর একটি এবং মার্কেট ভালুয়েশন অনুযায়ী অলরেডি বেশ বড়সড় একটা কোম্পানি। পাঠাও কোম্পানির বর্তমান মার্কেট ভালুয়েশন প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ৮৪০ কোটি টাকা। তারা কেবল রাইড শেয়ারিংয়ে সীমাবদ্ধ নেই, তাদের আছে উবারের মত কার সার্ভিস। আছে পার্সেল সার্ভিস, খাবার ডিলেভারি সার্ভিস, ডিজিটাল প্যামেন্ট সিস্টেম। পাঠাও কোম্পানির এইসব এনটিটির প্রত্যেকটির ভবিষ্যত অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। রাইড শেয়ারিং ভোক্তার একমাত্র চাহিদা নয়, তাদের আরো অনেক চাহিদা রয়েছে। যেহেতু পাঠাও এর অলরেডি একটা বড় কাস্টোমার বেইজ আছে, তারা চাইলেই ভোক্তাদের অন্যান্য চাহিদা পূরণে তাদের এস্টাবলিশড প্লাটফর্মকে ব্যবহার করতে পারে। এবং তারা সেটা করছেও। অত্যন্ত সফলভাবে। পাঠাও এখানেই থেমে থাকবে না, তারা আরো নিত্য নতুন সার্ভিস তাদের প্লাটফর্মে নিয়ে আসবে। পাঠাও এখন দেশের বাইরেও চলে গেছে। নেপালে পাঠাও সার্ভিস চালু হয়ে গেছে। পাঠাও একটি জায়ান্ট কোম্পানিতে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে কাজ করছে। সেই লক্ষ্যেই তারা এগিয়ে যাচ্ছে।
পাঠাও কোম্পানিতে একটা বিশেষ ব্রাঞ্চ আছে। এই ব্রাঞ্চে ডাটা মাইনিং করে বিজন্যাস স্ট্রাটেজি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ইনসাইট বের করা হয়। বুয়েটে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়ার সময় আমাকে ডাটা মাইনিং এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্ট নিয়ে পড়তে হয়েছিল। এ বিষয়ে আপনাদের কিছু ধারণা দিতে পারব।
আপনার ম্যাসেজ এবং কনটাক্ট লিস্টে এমনসব তথ্য থাকে যা দিয়ে আপনি মানুষ হিসেবে কেমন, আপনার সোশ্যাল এবং ফাইনান্সিয়াল স্ট্যাটাস কিরকম খুবই রিজনেবল একুরেসি দিয়ে বলে দেওয়া সম্ভব। যেমনঃ
* মাসের শুরুতে ব্যাংকগুলো আপনার জমা টাকার হিসাবের আপডেট দেয়। আপনার জমা টাকা বাড়ছে নাকি কমছে, কত হারে বাড়ছে কমছে তা দিয়ে আপনার সঞ্চয় ক্ষমতার লাইভ আপডেট তারা পাচ্ছে। আপনার বউ/জামাই থেকেও পাঠাও আপনার ফাইনান্সিয়াল স্ট্যাটাস সম্পর্কে বেশি জানে।
* আপনি আপনার মোবাইলে কত টাকা লোড করেন, কতদিন পরপর করেন, কত টাকার ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, আপনি জিপি স্টার ইউজার কিনা ইত্যাদি সব ইনফর্মেশন তাদের হাতের মুঠোয়। আমাদের কাছে এসব ম্যাসেজ বিরক্তিকর ঠেকলেও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে আপনার সোশ্যাল এবং ফাইনান্সিয়াল স্টেন্ডিং বুঝতে এসব ইনফর্মেশন খুবই কার্যকর।
* আপনি কাকে কোন দিবসে শুভেচ্ছা পাঠান, পাঠাও সেটা বিলক্ষণ জানে। ঐসব দিবস আসলে কোন ধরণের গিফট পাঠাতে আপনি রাজি হবেন, পাঠাও নোটিফিকেশনের মাধ্যমে আপনাকে সে বিষয়ে প্রলুব্ধ করতে পারে।
* আপনি কোথায় পড়াশুনা করেছেন, আপনি কোথায় কোথায় যান, আপনার ফ্রেন্ড সার্কেল কিরকম, আপনি দামী রেস্টুরেন্টে গিয়ে খান নাকি সাশ্রয়ী রেস্টুরেন্টে খান এসব কিছু ডাটা মাইনিং করে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বলে দিতে পারবে।
* অফিসে যেতে কিংবা মিটিং এ যেতে দেরি হচ্ছে দেখে ম্যাসেজ করেছেন, “চলে এসেছি, বড়জোর ১৫ মিনিট লাগবে”। অন্য প্রান্ত থেকে এসএমএসে ঝাড়ি খাচ্ছেন। আপনার এইসব ইনফর্মেশন দিয়ে আপনি কি করেন, আপনার জব কি, পাওয়ার স্ট্রাকচারে আপনার অবস্থান কি রকম খুব এক্যুরেটলি বলে দেওয়া সম্ভব।
* আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি যা বলে শেষ করা যাবে না।
আপনার মোবাইলে আর কোন কোন এপ ইন্সটল আছে সেটিও পাঠাও নিয়ে নিচ্ছে। তাদের প্রতিপক্ষ সার্ভিসগুলো আপনার মোবাইলে ইন্সটল আছে কিনা, প্রতিপক্ষ সার্ভিসগুলো কেমন ছাড় দিচ্ছে সেগুলো ম্যাসেজ থেকে পড়ে নিচ্ছে। সেক্ষেত্রে আপনাকে একটু বেশি ছাড় দিয়ে পাঠাও সার্ভিস ব্যবহারের জন্য আপনাকে প্রলুব্ধ করতে পারে। ধরুন পাঠাও ব্যবহার করতে করতে একসময় আপনি উবার এপটি ডিলিট করে দিলেন। এ বিষয়টিও পাঠাও জানবে। সেক্ষেত্রে সে বুঝে নিবে যে আপনি এখন পাঠাও এর লয়াল কাস্টোমারে পরিণত হয়েছেন। এখন আপনাকে কম ছাড় দিলেও চলে।
আপনার ব্যক্তিগত তথ্য তাদের হাতের মুঠোয় থাকার কারণে তাদেরকে জেনারালাইজড স্ট্রাটেজি নিতে হচ্ছে না, আপনি একজন ব্যক্তির জন্য কি বিজন্যাস স্ট্রাটেজি নিলে পাঠাও সবচেয়ে লাভবান হবে সেটা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বলে দিচ্ছে। সে আপনার সোশ্যাল স্ট্যান্ডিং, ইনকাম সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। ঠিক সে অনুযায়ী আপনাকে পার্সোনালাইজড ম্যাসেজ, নোটিফিকেশন দিবে, এড দিবে। এমপ্লয়ি হলে একভাবে ডিল করবে, বস হলে আরেকভাবে।
শুধু তাই নয়। কোন ছাড়, এড আসার পর আপনি কিভাবে রেসপন্স করছেন সে ইনফোও তাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাঠাও বিজন্যাস করতেছে। প্রত্যেক কাস্টোমার থেকে প্রফিট ম্যাক্সিমাইজেশন তার মূল লক্ষ্য। একসময় যদি দেখা যায় কম ছাড় দেওয়ার পরেও আপনি পাঠাও ব্যবহার করছেন (বিজন্যাসের ভাষায় কম ছাড় দিয়েও কনভার্শন হচ্ছে), তাহলে পাঠাও আপনাকে সেভাবেই ট্রিট করবে। আবার কনভার্শন রেইট কমে গেলে পাঠাও অন্যভাবে ট্রিট করবে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সে নিউরাল নেটওয়ার্ক নামের একটা জটিল সিস্টেমের মাধ্যমে এটি করা যায়। এটি স্বয়ংক্রিয় সিস্টেম। এই নিউরাল নেটওয়ার্কের কাজ হচ্ছে কাস্টোমারকে খুশি রেখে পাঠাওয়ের বিজন্যাসের গ্রোথ এবং প্রফিটকে ম্যাক্সিমাইজ করার জন্য নিরন্তর এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে যাওয়া।
পাঠাও জনপ্রিয় সার্ভিস হওয়ার কারণে তার কাছে জমা হওয়া ডাটাসেট অনেক বড়। কোটি কোটি ম্যাসেজ এবং লক্ষ লক্ষ নামসহ মোবাইল নাম্বার তাদের কাছে জমা হয়ে গিয়েছে। এই ডাটাসেট দিন দিন আরো বড় হতে থাকবে। এটা দিয়ে সারা বাংলাদেশের সোশ্যাল গ্রাফ বানিয়ে ফেলা সম্ভব। সোশ্যাল স্ট্যান্ডিং, ফাইনান্সিয়াল স্ট্যাটাস, পাওয়ার স্ট্রাকচার সব বের করে ফেলা সম্ভব। এটা আবার লাইভ আপডেট হতে থাকবে। যেকোন বিজন্যাসের জন্য এটি সোনার খনি। পাঠাও জানে তার এই সোনার খনির মূল্য বিলিয়ন ডলার। এমনকি এর মূল্য তার প্রোডাক্টগুলো থেকেও অনেক বেশি।
এতবড় সোনার খনির সন্ধান পেয়ে এমনি এমনি পাঠাও সেটি ছেড়ে দিবে!
Array