
ক্লাসে যোগ না দিয়ে বিক্ষোভ করে যাচ্ছিল মেয়েগুলো। ক্ষোভে ফেটে পড়া মেয়েগুলোর ডুকরে কান্না পাচ্ছিল। কয়েকজনের চোখ দিয়ে জলের ধারা বইতে শুরু করলে তা সংক্রমিত হয় অন্যদের মধ্যে। এর মধ্যে চলছিল ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘বিচার চাই, বিচার চাই’।
রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যার ঘটনায় দায়ী শিক্ষকদের বিচার চাইছিল মেয়েরা। তাদের সঙ্গে যোগ দেন অভিভাবকেরাও। অভিযোগ আছে, বাবাকে শিক্ষকদের অপমানের বিষয়টি সইতে না পেরে আত্মহত্যা করে অরিত্রী।
এ সময় কেউ দিচ্ছিল স্লোগান, কেউ হাতে নিয়ে দাঁড়ায় নানা প্ল্যাকার্ড, স্লোগান। একটি প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘এ কেমন শিক্ষা, যার জন্য শিক্ষার্থীকে জীবন দিতে হয়’। একটিতে লেখা ছিল, ‘উই ডিমান্ড আনসার ফ্রম দ্য অথরিটি (আমরা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জবাব চাই)। একটিতে লেখা ছিল, ‘দিস ইজ অ্যা স্কুল, নট অ্যা টর্চার সেল (এটা স্কুল, নির্যাতনকেন্দ্র নয়)’।
একটি শিশুর হাতে প্ল্যাকার্ডে ছিল ‘এডুকেশন এনলাইটেনস আস, ইট ডাজ নট কিলস আস (শিক্ষা আমাদের আলোকিত করে, হত্যা নয়)। একটিতে ছিল, ‘প্রিন্সিপাল অব ভিএনএসসি, শেম অন ইউ (ভিকারুননিসার অধ্যক্ষ, ছিঃ)’।
অরিত্রীর মৃত্যুর ঘটনাটি ছুঁয়ে গেছে সাধারণ মানুষকেও। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ছুটে গেছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। উচ্চ আদালত একটি কমিটি গঠন করে অরিত্রীর মৃত্যুর কারণ জানতে চেয়েছে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার কারণ জানতে করা হয়েছে কমিটি।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং স্কুল কর্তৃপক্ষও করেছে দুটি তদন্ত কমিটি। তাদের প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে তিন দিনের মধ্যে। এরই মধ্যে স্কুল কর্তৃপক্ষ বরখাস্ত করেছে অভিযুক্ত শিক্ষক জিন্নাত আরাকে। ক্ষমা চেয়েছেন ভিকারুননিসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস।
মানতে পারছেন না শিক্ষামন্ত্রী
মঙ্গলবার সকালে ক্লাসে যোগ না দিয়ে বিক্ষোভ করে ভিকারুননিসার মেয়েরা। যোগ দেন অভিভাবকেরাও। এই বিক্ষোভ চলাকালেই স্কুলে যান শিক্ষামন্ত্রী। তারা তাকে ঘিরে ধরে স্লোগানে স্লোগানে অরিত্রীর মৃত্যুর জন্য দায়ীদের শাস্তির দাবি করেন।
মন্ত্রী এরপর কথা বলেন শিক্ষকদের সঙ্গে। পরে কথা বলেন ছাত্রীদের সঙ্গে। বলেন, এই ঘটনা শুনে তিনি মর্মাহত হয়েছেন। বলেন, ‘একজন শিক্ষার্থী কতটা অপমানিত হলে, কতটা কষ্ট পেলে আত্মহত্যার মতো পথ বেছে নেয়…যে ঘটনাগুলো আমরা শুনেছি, এর পেছনের কথা শুনছি। ঘটনার পেছনে বা ঘটনার সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক, যদি প্রমাণ পাওয়া যায়, জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
দুটি তদন্ত কমিটি গঠন
এই মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সোমবার রাতেই মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের ঢাকা অঞ্চলের পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে।
কী ঘটেছে, কেন ঘটেছে এবং ঘটনার সঙ্গে কারা দায়ী এবং করণীয় বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করে কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন মাউশির ঢাকা অঞ্চলের উপপরিচালক সাখায়েত হোসেন বিশ্বাস এবং ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিসার বেনজির আহমদ।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘এখানে যে ঘটনাটি ঘটেছে তা অনাকাক্সিক্ষত এবং কষ্টদায়ক। কতটা কষ্ট পেলে নিজের জীবন দিতে পারেÑশিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনায় সেটাই উঠে এসেছে। বিষয়টি খুবই গুরুতর। এ বিষয়ে সঠিক তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
আরেকটি কমিটি করেছে ভিকারুননিসা স্কুল কর্তৃপক্ষও। প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান আশরাফ তালুকদার বলেন, ‘যে শিক্ষক তাকে ভর্ৎসনা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে বা যিনি ঘটনার সঙ্গে যুক্ত বলে অভিযোগ উঠেছে, তদন্তে যদি এর প্রমাণ পাওয়া যায়, তবে স্কুলের নিয়ম অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে স্কুল কর্তৃপক্ষ।
ক্ষমা চাইলেন স্কুলপ্রধান, অভিযুক্ত শিক্ষক বরখাস্ত
শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের আন্দোলনের মধ্যে ক্ষমা চেয়েছেন প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস। গণমাধ্যমকর্মীরা স্কুলে গেলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি অনাকাক্সিক্ষত। ঘটনাটি এত দূর গড়াবে তা অনুধাবন করতে পারিনি। এরই মধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তা মন্ত্রণালয় নির্ধারণ করে দেবে। আত্মহত্যার ঘটনায় আমি সবার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি।’
প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান আশরাফ তালুকদার বলেন, ‘প্রভাতি শাখার প্রধান শিক্ষক জিন্নাত আরাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন না আসা পর্যন্ত জিন্নাত আরাকে স্কুলের সব ধরনের কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।’
শিক্ষার্থীদের তিন কর্মসূচি
শিক্ষার্থীরা তিনটি কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। প্রথমত, শিক্ষামন্ত্রীর দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তিন দিনের মধ্যে সুষ্ঠু বিচার না হলে আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। দ্বিতীয়ত, সব পরীক্ষা বর্জন। তৃতীয়ত, বুধবার সকাল ১০টায় ফের প্রধান ফটকে অবস্থান নেওয়া।
আত্মহত্যা প্রতিরোধে নীতিমালা চায় হাইকোর্ট
শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা প্রতিরোধের উপায় খুঁজতে নীতিমালা করতে অতিরিক্ত শিক্ষাসচিবের নেতৃত্বে কমিটি করে দিয়েছে হাইকোর্ট। কমিটিকে এক মাসের মধ্যে এ বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে বলেছে। অরিত্রীর আত্মহত্যার কারণ খুঁজতেও দিতে হবে আলাদা প্রতিবেদন।
মঙ্গলবার বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এই আদেশ দেয়।
বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে অরিত্রীর আত্মহত্যার প্রকাশিত খবর আদালতের নজরে আনেন চার আইনজীবী অনীক আর হক, জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, আইনুন্নাহার সিদ্দিকা ও জেসমিন সুলতানা। এরপর এই আদেশ আসে।
পাঁচ সদস্যের কমিটিতে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিবের নিচে নয়, এমন একজন প্রতিনিধি, শিক্ষাবিদ, মনোবিদ ও আইনবিদকে রাখতে বলা হয়েছে।
একটি রুলও জারি করা হয়। এতে অরিত্রীর আত্মহত্যার মতো ঘটনা প্রতিরোধের উপায় নির্ণয় করে একটি জাতীয় নীতিমালা প্রণয়নের পদক্ষেপ নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে রুলে।
সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে বলে জানান এই আইনজীবী।
যা ঘটেছিল
অরিত্রীর বাবা দিলীপ অধিকারী সাংবাদিকদের বলেন, ‘অরিত্রীর স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা চলছিল। রবিবার সমাজবিজ্ঞান পরীক্ষা চলার সময় তার কাছে একটি মোবাইল ফোন পাওয়া যায়। এ জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ আমাদের ডেকে পাঠায়। তখন আমি ও আমার স্ত্রী স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপালের কক্ষে যাই।’
“ভাইস প্রিন্সিপাল বলেন, ‘মোবাইলে অরিত্রী নকল করছিল।’ আমরা এ জন্য ক্ষমা চাইলে তিনি প্রিন্সিপালের কক্ষে পাঠান। প্রিন্সিপালের কক্ষে গিয়েও আমরা ক্ষমা চাই। কিন্তু প্রিন্সিপাল সদয় হননি। একপর্যায়ে তার পায়ে ধরে ক্ষমা চাই; কিন্তু প্রিন্সিপাল আমাদের বেরিয়ে যেতে বলেন। তিনি অরিত্রীকে টিসি (ছাড়পত্র) দেওয়ার নির্দেশ দেন।”
গত সোমবার দুপুরে ঢাকার শান্তিনগরের বাসায় নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করে অরিত্রী।