
করোনার প্রাদুর্ভাবে নিত্যপণ্যের বাজারে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। চাল, ডাল, আটা, মাংস, শাকসবজি, তেল, পেঁয়াজ, মসলাসহ বিভিন্ন পণ্যের লাগামহীন দাম। ফলে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। এ অবস্থায় নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থানে সরকার। ইতোমধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য স্বাভাবিক রাখতে বাজারগুলোতে বিশেষ অভিযান শুরু করছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম লাগামহীন। এসবের বাইরে এবার যোগ হয়েছে আলু। সঙ্গে ভোজ্যতেল, ডিম, আদা, রসুন ও সবজির উচ্চ দামও মানুষকে ভোগাচ্ছে। বাজারে ৫০ টাকা কেজির নিচে সবজি নেই বললেই চলে। দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতির পদতলে জনজীবন পিষ্ট হয়ে পড়েছে। জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার কারণে দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে সাধারণ মানুষের যেন ভোগান্তির শেষ নেই। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি মোটা চালের মধ্যে স্বর্ণা জাতের চাল বিক্রি হয়েছে ৪৮-৫০ টাকায়, যা এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ৪২-৪৪ টাকায়। প্রতি কেজি মসুর ডাল (বড়দানা) বিক্রি হচ্ছে ৭৫-৭৮ টাকা, যা এক মাস আগে ছিল ৬৮-৭০ টাকা। খোলা আটা প্রতি কেজি ৩০-৩২ টাকা, এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ২৫-২৬ টাকা। ভোজ্য তেলের মধ্যে খোলা সয়াবিন প্রতি লিটার বিক্রি হয়েছে ৮৬-৮৭ টাকা, এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ৭৯-৮২ টাকায়। পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন বিক্রি হয়েছে ৫১০ টাকা, এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ৫০০ টাকায়।
রাজধানীর বেশ কয়েটি বাজারে দীর্ঘদিন ধরেই চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে সবজি। কিছু সবজির কেজি ১০০ টাকা ছুঁয়েছে। আর কিছু সবজির কেজি বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকার কাছাকাছি। সবজির এমন চড়া বাজারে নতুন করে দাম বেড়েছে ডিম, আলু ও কাঁচামরিচের।
গত সপ্তাহে ৪০ থেকে ৪২ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া আলুর দাম বেড়ে হয়েছে ৫৫-৬০ টাকা। ১১০ থেকে টাকা ডজন বিক্রি হওয়া ডিমের দাম বেড়ে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত চার মাসের বেশি সময় ধরে চড়া দামে বিক্রি হওয়া কাঁচামরিচের দাম নতুন করে আরো বেড়েছে। এক কেজি কাঁচামরিচ এখন বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায়।
রাজধানীর গেণ্ডারিয়ার বাসিন্দা রিয়াজুল ইসলাম আকাশ ধূপখোলা বাজারে গিয়ে হতাশ। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, প্রতিদিনই নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। ফলে আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের চরম বিপাকে পড়তে হচ্ছে। আমাদের আয় সীমিত। এই আয়ে বাজার করা দুষ্কর হয়ে পড়েছে।
তিনি আরো বলেন, ভালো চাল কিনতে গেলে কেজিপ্রতি ৫২-৫৬ টাকা গুনতে হয়। পেঁয়াজের কেজি তো প্রায় ১০০ ছুঁই ছুঁই করছে। কাঁচামরিচের কেজি এখন ৩০০ টাকা। নিত্যপণ্যের এই ঊর্ধ্বগতিতে এবার যোগ হয়েছে আলু। ৫৫ টাকার নিচে আলু নেই বাজারে। এছাড়া কোনো সবজির দামই অর্ধশতকের নিচে নয়। তাহলে আমরা খাবটা কী?
এদিকে দাম বাড়ানোর পেছনে সেই আগের অজুহাত দেখাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, তিন কারণে পণ্যের দাম বাড়ছে। এর মধ্যে রয়েছে- ভারতসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যার কারণে পণ্যের উৎপাদন কমেছে। ইন্দো প্রদেশে পেঁয়াজের মোকামে শ্রমিকদের ধর্মঘট এবং মাওয়া ঘাটে ফেরি পারাপার বন্ধের কারণে পণ্য ঢাকায় আসতে পারছে না। ফলে বাজারে সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
ধূপখোলা বাজারের খুচরা দোকানদার মোক্তার হোসেন বলেন, মিলারদের কারসাজিতে এখন পর্যন্ত চালের দর বাড়তি। তারা সিন্ডিকেট করে মিল পর্যায় থেকে সব ধরনের চালের দর বাড়িয়ে দিয়েছে। যে কারণে পাইকারি থেকে খুচরা পর্যায়ে চালের দর বাড়তি। এছাড়া তেল কোম্পানিগুলো নতুন করে রেট দিয়েছে। যে কারণে বেশি দরে এনে বেশি দরে বিক্রি করতে হচ্ছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দাবি, দেশে চাল, ডাল, তেল পেঁয়াজসহ সব পণ্যেরই মজুত ও সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। করোনাভাইরাসকে কেন্দ্র করে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অনৈতিক লাভের নেশায় মেতে উঠেছে। কেউ কেউ পণ্য মজুত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে। এতে নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। কষ্ট বাড়ছে নিম্নআয়ের মানুষের।
মন্ত্রণালয়ের সূত্র আরো জানায়, নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে কঠোর অবস্থানে সরকার। কোনো পরিস্থিতিতেই নিত্যপণ্যের বাজার যাতে অস্থির হতে না পারে সেজন্য কৌশল নির্ধারণও করা হচ্ছে। পণ্যের সরবরাহ ঠিক রাখার পাশাপাশি যাতে কেউ কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করতে না পারে, সে বিষয়টি কঠোরভাবে মনিটরিংয়ের মাধ্যমে নিত্যপণ্যের দাম সাধারণ ক্রেতার সাধ্যের মধ্যে রাখতে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রয়োজন হলে আমদানিনির্ভর পণ্যগুলোর সরবরাহ ঠিক রাখার জন্য আমদানির পরিমাণ বাড়িয়ে মজুত স্বাভাবিক রাখা হবে।
জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, কিছু কিছু পণ্যের দাম বাড়ছে। তবে নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার সব সময় কঠোর অবস্থানে রয়েছে। টিসিবিসহ সরকারি সংস্থাগুলো কাজ করছে। বাজারে পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার পাশাপাশি দ্রব্যমল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে বাজার মনিটরিং কার্যক্রম আরো জোরদার করা হচ্ছে।
গতকাল রাজধানীর পাইকারি ও খুচরা বাজারে আলু, পেঁয়াজ, চালসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য যৌক্তিক মূল্যে বিক্রি হচ্ছে কি না, তা মনিটরিং করতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পাঁচটি টিম রাজধানীর খুচরা ও পাইকারি বাজারে অভিযান পরিচালনা করেছে। এর মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাজার মনিটরিংয়ের দুটি টিমও রয়েছে।
অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. মাসুম আরেফিন জানান, অনৈতিকভাবে যারা বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়াবে তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী জরিমানা ও শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আবার পর্যাপ্ত মজুত থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ করে কোনো কারণ ছাড়াই লাফিয়ে বাড়ছে আলুর দাম। মাসের ব্যবধানে আলুর দাম দ্বিগুণ বেড়ে এখন খুচরা বাজারে ৫৫ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ অবস্থায় প্রতি কেজি আলুর দাম হিমাগারে ২৩ টাকা, পাইকারিতে ২৫ টাকা এবং খুচরা বাজারে ৩০ টাকা দরে বিক্রি নিশ্চিত করতে সারা দেশের জেলা প্রশাসকদের চিঠি দিয়েছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। একই সঙ্গে উল্লিখিত দামে কোল্ডস্টোরেজ, পাইকারি বিক্রেতা ও ভোক্তা পর্যায়ে খুচরা বিক্রেতাসহ তিন পক্ষই যাতে আলু বিক্রি করেন সেজন্য কঠোর মরিটরিং ও নজরদারির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানিয়ে ডিসিদের কাছে পাঠানো হয়েছে চিঠি।
চিঠিতে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর জানায়, বাংলাদেশে গত আলুর মৌসুমে প্রায় ১ দশমিক ৯ কোটি টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। দেশে মোট আলুর চাহিদা প্রায় ৭৭ দশমিক ৯ লাখ টন। এতে দেখা যায়, গত বছর উৎপাদিত মোট আলু থেকে প্রায় ৩১ দশমিক ৯১ লাখ টন আলু উদ্বৃত্ত থাকে। কিছু পরিমাণ আলু রপ্তানি হলেও ঘাটতির আশঙ্কা নেই। এ মৌসুমে একজন চাষির প্রতি কেজি আলু উৎপাদনে খরচ হয়েছে ৮ টাকা ৩২ পয়সা।
অথচ বর্তমানে বাজারে বিক্রমপুরের আলু খুচরায় প্রতি কেজি ৫৫ থেকে ৫৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর রংপুর ও রাজশাহীর আলুর কেজি ৫৮ থেকে ৬০ টাকা।
Array