
‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় অপ্রতিরোধ্য বাংলাদেশ।’ দুটি রূপকল্প অনুযায়ী ২০২১ সালের মধ্যে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত-মধ্যম আয়ের বাংলাদেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে সোনার বাংলা গড়ার প্রতিশ্রুতি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের। জনগণকে দেয়া নির্বাচনী ওয়াদা পূরণে গতকাল বৃহস্পতিবার ‘সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় উন্নত বাংলাদেশ’ শীর্ষক বাজেট পেশ করেছে সরকার। প্রস্তাবিত এই বাজেটে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকারের প্রতিফলন ঘটেছে। বাজেটে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, সামাজিক নিরাপত্তা, দারিদ্র্যবিমোচন, কর্মসংস্থান তৈরি ও বেকারত্ব দূরীকরণের ওপর। আওয়ামী লীগের দাবি, জনকল্যাণমুখী এই বাজেট দলের প্রতিশ্রুতি পূরণের দিকে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য বাজেট পৃথিবীতে কেউ দিতে পারেনি। বাজেট সাধারণ জনগণের জন্য কতটুকু সুফল বয়ে আনবে এটাই দেখার বিষয়।
বিশ্লেষকদের মতে, উন্নত বাংলাদেশ গড়ার প্রথম ধাপ হচ্ছে অবকাঠামো নির্মাণ। সরকার শুরু থেকেই অবকাঠামো নির্মাণের ওপর গুরুত্ব দিয়ে আসছে। গতকাল ঘোষিত আওয়ামী লীগের টানা তৃতীয় মেয়াদের প্রথম বাজেটেও সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে যোগাযোগ খাতে (উন্নয়ন খাতে)। পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেটে এ খাতের জন্যই বরাদ্দ ৬৪ হাজার ৮২০ কোটি টাকা। যা মোট উন্নয়ন বাজেটের ২৬.১ শতাংশ। পদ্মা সেতু, গভীর সমুদ্রবন্দর, দ্রুত গণপরিবহনের জন্য অবকাঠামো নির্মাণ, মহেষখালী-মাতারবাড়ী সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন, পায়রা সমুদ্রবন্দর, পদ্মা সেতু রেলসংযোগ, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার পর্যন্ত ১২৯.৫ কিলোমিটার রেললাইন তৈরির কাজগুলো শেষ করার জন্য এ খাতে সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দ যৌক্তিক বলে মনে করছেন তারা। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী, প্রতিটি গ্রামে আধুনিক নগর সুবিধা সম্প্রসারণের জন্যও অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রয়োজন।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের মূল বিষয় তরুণ ও যুব সমাজকে দক্ষ জনশক্তিকে রূপান্তরিত করা এবং কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, যুব উন্নয়নের জন্য বাজেটে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, তারুণ্যের শক্তি-বাংলাদেশের সমৃদ্ধি-এ স্লোগানকে সামনে রেখে দেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ যুব সমাজকে সুসংগঠিত, সুশৃঙ্খল এবং উৎপাদনমুখী শক্তিতে রূপান্তরের জন্য সরকার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে তিন কোটি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্বের অবসান ঘটানো হবে।
প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষায় ১৮.২ শতাংশ, স্বাস্থ্যে ৫.৮ শতাংশ, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতে ১৫.৪ শতাংশ, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ১৩.২ শতাংশ, জনপ্রশাসনে ৬.১ শতাংশ, কৃষিতে ৫.৪ শতাংশ এবং সামাজিক নিরাপত্তায় ২.৭ শতাংশ উন্নয়ন বাজেট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বাজেটে জিডিপি ধরা হয়েছে ২৫ লাখ ৩৭ হাজার ৮৪৯ কোটি টাকা। গড় মূল্যস্ফীতি ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। বাজেট ঘোষণার পরে কোনো জিনিসপত্রের দাম বাড়বে না বলেও জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।
প্রস্তাবিত বাজেট জনকল্যাণমুখী এ মন্তব্য করে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক ভোরের কাগজকে বলেন, টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের সমন্বয়ে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়াই আওয়ামী লীগের মূল লক্ষ্য। এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কাজ করছে সরকার। বাজেটে তারই প্রতিফলন ঘটেছে।
দলের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ বাজেট দিয়েছে সরকার। এতে জনগণের কল্যাণ ও অগ্রগতি নিহিত রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে।
এদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আকার নয় বরং বাজেট কতটা জনকল্যাণমুখী সেটাই বিচার্য। রাষ্ট্র কাকে কতটুকু আশীর্বাদ দিচ্ছে আর কার ওপর থেকে আশীর্বাদের হাত সরিয়ে নিচ্ছে এটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. শান্তনু মজুমদার ভোরের কাগজকে বলেন, বাজেটে মৌলিক বিষয়গুলো কতটুকু প্রতিফলিত হয়েছে, যেমন শিক্ষা খাতে যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তা সাধারণ, ধর্মীয় এবং সামরিক শিক্ষা খাত মিলিয়ে কিনা এ বিষয়টি দেখা দরকার। এ ছাড়া বাজেটের কিছু বিষয় নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা উচিত। প্রতিটি বাজেটেই কিছু বিষয় নিয়ে কখনোই আলোচনা হয় না। এমনকি সংসদীয় কমিটিতেও না। এসব বিষয় আলোচনা হওয়া উচিত। তিনি বলেন, দলীয় সরকার দলীয় বাজেট দেবে, এটাই স্বাভাবিক। বাজেটে মোটাদাগে দলের প্রতিশ্রুতি পূরণের দিকটি উঠে এসেছে। এটি ইতিবাচক দিক। অন্যদিকে বিরোধীদলের সংস্কৃতি বাজেট পেশ করার আগেই একটি বিরোধী বক্তব্য তৈরি করে রাখা। সরকারের উচিত হবে, জনগণ এবং রাষ্ট্রের সার্বিক কল্যাণে দায়িত্ব পালন করা।