• ঢাকা, বাংলাদেশ

ভাষা আন্দোলনের আদ্যোপান্ত 

 admin 
21st Feb 2019 9:18 pm  |  অনলাইন সংস্করণ

পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষাভাষী জাতির মধ্যে বাঙালি-ই একমাত্র জাতি, যারা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে। মায়ের ভাষাকে প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছে। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে সালাম, রফিক, বরকত বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে বাংলাকে তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলো। সেদিনের সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ধারাবাহিক আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি আমাদের প্রাণপ্রিয় স্বাধীনতা। পৃথিবীর আর কোনো জাতি তাদের মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য এভাবে অকাতরে প্রাণদান করেছে বলে আমাদের জানা নেই। ২১ ফেব্রুয়ারি তাই স্বীকৃতি লাভ করে মহান ভাষা দিবস বা শহীদ দিবস হিসেবে। পরবর্তী সময়ে নজিরবিহীন সেই ঘটনার এ দিবসটিকে জাতিসংঘ ঘোষণা করেছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে। ৫২তে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল সেটা আমরা অনেকে জানলেও, জানিনা এর নেপথ্য কাহিনী। নতুন বার্তার পাঠকদের জন্য আজ থাকছে ২১ ফেব্রুয়ারির আদ্যোপান্ত।

বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রথম দাবী

১৯৪৭ তমদ্দুন মজলিস পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে; ”বাংলা নাকি উর্দু” নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে যেখানে সর্বপ্রথম বাংলাকে পাকিস্তানের একটি রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ঘোষণা করার দাবী করা হয় । সেই সময়ে সরকারী কাজকর্ম ছাড়াও সকল ডাকটিকেট, পোষ্টকার্ড, ট্রেন টিকেটে কেবলমাত্র উর্দু এবং ইংরেজিতে লেখা থাকতো । পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বাংলা সংস্কৃতিকে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি এবং বাংলা ভাষাকে হিন্দুয়ানী ভাষা হিসাবে অভিহিত করে এবং তারা পূর্ব-পাকিস্তানের সংস্কৃতিকে “পাকিস্তানীকরণ”, যেটি উর্দু এবং তাদের ভাষায় ইসলামিক, করার চেষ্টা চালাতে থাকে । তমদ্দুন মজলিশের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক আবুল কাশেম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হওয়া উচিত সে ব্যাপারে একটি সভা আহবান করেন।

সভায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে পাকিস্তান সরকারের কাছে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় আন্দোলন করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বাংলাদেশের অন্য সকল আন্দোলনের মত ভাষা আন্দোলনের শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পাকিস্তানের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের উদ্যোগে পশ্চিম পাকিস্তানে আয়োজিত “পাকিস্তান এডুকেশনাল কনফারেন্সে” পূর্ব -পাকিস্তান হতে আগত প্রতিনিধিরা উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন এবং বাংলাকেও সম-অধিকার প্রদানের দাবী জানান। ৭ নভেম্বর ১৯৪৭ : পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের সভায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করা হয়। ১৭ নভেম্বর ১৯৪৭: পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলাকে ঘোষণা দেওয়ার জন্য শত শত নাগরিকের স্বাক্ষর সংবলিত স্মারকপত্র প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের কাছে পেশ করা হয়।

শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্টুডেন্ট লীগের জন্ম
১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে পূর্ব পাকিস্তান স্টুডেন্ট লিগের জন্ম। এর প্রথম সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তখন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। পূর্ব পাকিস্তান ষ্টুডেন্টস লীগে ডান ও বামধারার ছাত্রনেতাদের একটি সম্মেলন হয়। উল্লেখ্য, প্রতিষ্ঠাতাদের প্রায় সবাই ছিলেন মুসলিম ছাত্রনেতা। এটি গঠনের মূল লক্ষ্য ছিল মুসলিম লীগ সরকারের অ্যান্টি বেঙ্গলী পলিসির বিপক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তোলা।

ভাষার বছর ১৯৫২

১৯৫২ এর ২৬ জানুয়ারিতে পুনরায় উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে অ্যাসেম্বলীতে চূড়ান্ত নির্দেশনা প্রদান করে। ২৭ জানুয়ারি ঢাকা সফররত পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্ণর জেনারেল খাজা নাজিমুদ্দিন পল্টন ময়দানের সমাবেশে ঘোষণা করেন কেবল মাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। সাথে সাথে সমাবেশস্থলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। স্লোগান ওঠে “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”। এই বক্তব্য সমগ্র পূর্ব -পাকিস্তানে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। মাওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ভাসানীর নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলনে ছাত্রদের পাশাপাশি আওয়ামী মুসলিম লীগের সরাসরি এবং সক্রিয় অংশগ্রহণের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

৩১ শে জানুয়ারি ১৯৫২ ভাসানীর সভাপতিত্বে পূর্ব-পাকিস্তানের সকল রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবিদের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলন থেকে কাজী গোলাম মাহবুবকে আহবায়ক করে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারী সমগ্র পূর্ব-পাকিস্তানে সাধারণ ধর্মঘট আহবান করে। ১৯৫২ এর ১৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সরকার ২১ ফেব্রুয়ারী ডাকা সাধারণ ধর্মঘটের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে এবং সকল সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ : পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ১৪৪ ধারা জারির পরিপ্রেক্ষিতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এর উদ্যোগে আবুল হাশিম এর সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় উপস্থিত সদস্যগণ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার ব্যাপারে নেতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

২১ শে ফেব্রুয়ারির সারাদিন

২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সকাল ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জিমনেশিয়াম মাঠের পাশে ঢাকা মেডিকেল কলেজের গেটের পাশে ছাত্র-ছাত্রীদের জমায়েত শুরু। সকাল ১১ টায় কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, আব্দুল মতিন, গাজীউল হক প্রমুখের উপস্থিতিতে ছাত্র-ছাত্রীদের সমাবেশ শুরু। সমাবেশে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ব্যাপারে ছাত্র নেতৃবৃন্দ এবং উপস্থিত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেয়। বেলা ১২টা থেকে বিকেল ৩টায় উপস্থিত ছাত্রনেতাদের মধ্যে আব্দুল মতিন এবং গাজীউল হক ১৪৪ ধারা ভংগের পক্ষে মত দিলেও সমাবেশ থেকে নেতৃবৃন্দ এ ব্যাপারে কোন সুনির্দিষ্ট ঘোষণা দিতে ব্যর্থ হন। এ অবস্থায় উপস্থিত সাধারণ ছাত্ররা স্বত:স্ফুর্তভাবে ১৪৪ ধারা ভংগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং মিছিল নিয়ে পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের অন্তর্গত) দিকে যাবার উদ্যোগ নেয়। এ সময় পুলিশ লাঠিচার্জ এবং গুলি বর্ষণ শুরু করে। গুলিতে ঘটনাস্থলেই আবুল বরকত, রফিকউদ্দিন আহমদ, এবং আব্দুল জব্বার নামের তিন তরুণ মৃত্যু বরণ করেন। পরে হাসপাতালে আব্দুস সালাম মৃত্যু বরণ করেন। পুলিশের সাথে ছাত্রদের ৩ ঘন্টাব্যাপী সংঘর্ষ চলতে থাকে কিন্তু পুলিশ গুলিবর্ষণ করেও ছাত্রদের স্থানচ্যূত করতে ব্যর্থ হয়। বেলা ৪টায় ছাত্রদের মিছিলে গুলিবর্ষনের ঘটনা ঢাকায় ছড়িয়ে পড়লে হাজার হাজার সাধারণ জনতা ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে জড়ো হতে থাকে।

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি প্রদান

১৯৫৬ এর ১৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের গণপরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করে তা সংবিধানের অন্তর্গত করার জন্য প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। ১৯৫৬ এর ২১ ফেব্রুয়ারি প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার কর্তৃক শহীদ মিনারের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন। ১৯৬৩ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী শহীদ আবুল বরকতের মা হাসিনা বেগম কর্তৃক এই শহীদ মিনারের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। ১৯৫৬ এর ২৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান জাতীয় সংসদে বাংলা এবং উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধান পাশ করে। ১৯৫৬ এর ৩ মার্চ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি প্রদানকারী পাকিস্তানের সংবিধান এইদিন থেকে কার্যকর হয়। ১৯৫৬ এর ১৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের গণপরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করে তা সংবিধানের অন্তর্গত করার জন্য প্রস্তাব উত্থাপিত হয় । অবশেষে বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে আমাদের মায়ের ভাষা রাষ্ট্র ভাষায় প্রতিষ্ঠিত হয়।

Array
We use all content from others website just for demo purpose. We suggest to remove all content after building your demo website. And Dont copy our content without our permission.
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
Jugantor Logo
ফজর ৫:০৫
জোহর ১১:৪৬
আসর ৪:০৮
মাগরিব ৫:১১
ইশা ৬:২৬
সূর্যাস্ত: ৫:১১ সূর্যোদয় : ৬:২১