
পতিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে টেনে তোলার জন্য এতদিন পর পথ দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরিচালকদের ইচ্ছামতো লুটপাট ও অপরাধ বুঝতে পারার পরও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিতে পারার কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু অসৎ কর্মকর্তাও যুক্ত হয়ে লুটপাটের ষোলকলা পূর্ণ করে। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, আইন সংশোধন করে পরিচালক নিয়োগসহ বেশ কিছু পরিবর্তন আসছে। নতুন আইনে দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব হবে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সর্বাধিক খেলাপি ঋণ। ব্যাংকগুলোতে বড় বড় স্ক্যাম, দুর্নীতি, অপশাসনের পরও খেলাপি ঋণের হার ৮ শতাংশের নিচে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে এ হার আরও কম। অন্যদিকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণের হার ১৫ শতাংশের উপরে। ৬৪ হাজার ২১৫ কোটি বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে ১০ হাজার ২৪৪ কোটি টাকাই খেলাপি। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণের অভাব, নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের সাথে কর্মকর্তাদের দুর্নীতি এবং আইনের সীমাবদ্ধতার কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি চরমে উঠেছে। অর্থ বিনিয়োগ করে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকরা সংকটে আছে। পিপলস লিজিংয়ের অবসায়নের কার্যক্রম শুরু করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করার আইন যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। বিশেষ করে পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগসাজশে কিছু দুর্নীতিবাজ ইচ্ছামতো শেয়ার কিনে পরিচালক হয়েছে। তারপর প্রভাব খাটিয়ে নামে বেনামে শত শত কোটি টাকা বের নিয়ে গেছে। যখন টাকা ফেরত দেওয়ার সময় হয়েছে তখন পরিচালককে খুঁজে পাওয়া যায়নি, যে প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণের নামে টাকা তুলে নিয়ে গেছে সে প্রতিষ্ঠানের হদিশ মেলেনি। পিকে হালদারের ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটেছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্বল পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা ষোলোকলা পূর্ণ হতে সহায়তা করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যেই দেখা যায়, ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ১১টি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের হার ১৫ শতাংশের উপরে। তিনটি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের হার ৫০ থেকে ৬৪ শতাংশ পর্যন্ত। পরিচালকদের নামে বেনামে টাকা সরিয়ে নেওয়ার জন্য বেশি বেশি আমানত সংগ্রহের প্রয়োজন ছিল। তারা এ ক্ষেত্রে সুদ হারের প্রস্তাব করেছে সর্বোচ্চ। আর বিনিয়োগ করার নামে নিজেরাই টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ফলে এ টাকা আর ফেরত দেয়নি। গ্রাহকরা বিভিন্ন মহলে টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য দৌড়াদৌড়ি শুরু করলে বিষয়টি সামনে আসে। এ সময় পিপলস লিজিংয়ের পরিচালকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিষয়টি সামনে আসে। দেউলিয়া হওয়ার আবেদন করে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে থেকে।
প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকরাই নামে বেনামে বিপুল পরিমাণ টাকা বের করে নিয়ে যায়-এমন তথ্য সামনে আসে। ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিসেস লিমিটেডে, রিলায়েন্স ফাইন্যান্সসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে নিঃস্ব হয় পিকে হালদার গং কা-ে। পুরো আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাত অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থা নিমজ্জিত হয়ে পড়ে।
অভিযোগ আছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তারা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের দুর্নীতি ধরে আনলেও মহাব্যবস্থাপক পর্যায়ের দুর্নীতিগ্রস্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা যোগসাজশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং তারাও বড় ধরনের ঘুষের বিনিময়ে চেপে গেছে। সম্প্রতি তৎকালীন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের মহাব্যবস্থাপক ও বর্তমানে নির্বাহী পরিচালক শাহআলমকে ব্যাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট দায়িত্ব থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় এ ব্যাপারে কৈফিয়ত তলব করা হয়। তবে অজ্ঞানত কারণে ওই কর্মকর্তা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। উচ্চ আদালতে ডেকে পাঠানো হয়ে একজন ডেপুটি গভর্নরকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের একজন কর্মকর্তার ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকেই গল্প প্রচলিত আছে তার এত টাকা হয়েছে সে ইচ্ছা করলে একাই একটি ব্যাংক কিনে নিতে পারে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এমন অবস্থা নিয়ে তিন বছর আগেই সংশ্লিষ্ট একজন পরিদর্শক নাম না প্রকাশের শর্তে খোলা কাগজকে বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির অনিয়মে খবর আগেই আমরা দিয়েছি। কিন্তু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কোনো ব্যবস্থা নেননি। তখন ব্যবস্থা নিলে এখন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের যে সর্বনাম দেখছি-তা হতো না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারাই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আইনের দুর্বলতাকে দুষছে। তাদের মতে, শুধু পরিচালক নিয়োগের বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ থাকলে দুর্নীতি রোধ করা যাবে। সরকার আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আইনের সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। আইন সংশোধনের কার্যক্রম ইতোমধ্যে শেষ পর্যায়ে আছে। নতুন আইন হলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির রথ থামানো যাবে। বিশেষ করে পরিচালক নিয়োগ ও পরিচালকের ঋণের বিষয়টি ধরতে পারলে অন্যরা দুর্নীতি করার সাহস পাবে না।
Array