
‘আমি ঘুরিয়া ঘুরিয়া
সন্ধান করিয়া
স্বপ্নের ঐ পাখি ধরতে চাই
আমার স্বপ্নেরই কথা বলতে চাই
আমার অন্তরের কথা বলতে চাই’
এই স্বপ্নের কথা বলতে চাওয়া পাখি টা মরে গেছে। তবু বাংলাদেশের বাতাসে তাঁর সুর ভেসে বেড়ায়। অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তিনি বুক টানটান করে দাঁড়িয়ে থাকতেন। মানুষের পাঁজরের ইতিহাস তাঁকে ভাবাতো। তিনি গানে গানে
বলতেন বিপ্লবের গল্প, প্রেম কিংবা অপ্রেমের গল্প। স্বাধীন বাংলাদেশে স্বপ্নের কথা বলায় উদ্ধত রাইফেল আর উদ্ধত বেয়নেট তাকে কখনো থামাতে পারেনি। শ্রেনী বৈষম্য আর রাষ্ট্রের তথাকথিত উন্নয়নের ভিতর যে বঞ্চনা তা বলেছেন তীব্র ক্রোধে।
‘আমি তোমাকেই বলে দেব
কি যে একা দীর্ঘ রাত, আমি হেঁটে গেছি বিরান পথে
আমি তোমাকেই বলে দেব
সেই ভুলে ভরা গল্প, কড়া নেড়ে গেছি ভুল দরজায়
ছুঁয়ে কান্নার রং, ছুঁয়ে জোছনার ছাঁয়া’
সবাইকে কান্নার রং আর বিষাদের মেঘে ঢেকে দিয়ে সবার প্রাণের মানুষ সঞ্জীব চৌধুরী ২০০৭ সালের ১৯ নভেম্বর রাতে অনন্ত শূণ্যতার পথে পাড়ি জমান। আজ সঞ্জীব চৌধুরীর এগারতম মৃত্যুবার্ষিকী। ডানা ভাঙা শালিকের কাছে হৃদয়ের দাবী রাখা এই আগুন পাখি মহাকালে স্বপ্নের গান গেয়ে চলুক অনন্তকাল।
সঞ্জীব চোধুরীর আলোকিত পথচলা
সঞ্জীব চৌধুরী ছোটবেলায় হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। এরপর ঢাকার বকশী বাজার নবকুমার ইন্সটিটিউটে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হন। এখান থেকে ১৯৭৮ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় মেধা তালিকায় ১২তম স্থান অর্জন করেন। ১৯৮০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেও মেধা তালিকায় স্থান করে নেন তিনি। তার বাবা ননী গোপাল চৌধুরী এবং মা প্রভাষিণী দেবী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা সঞ্জীব চৌধুরী আশির দশকে সাংবাদিকতা শুরু করেন। সে সময়ই ‘শঙ্খচিল’ নামের দলে সঙ্গীতচর্চা শুরু হয় তার। সাংবাদিকতার ক্যারিয়ারে তিনি বহু বছর ‘ভোরের কাগজে’র ফিচার বিভাগে দায়িত্বরত ছিলেন। সাংবাদিকতায় নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিলেন সঞ্জীব চৌধুরী। মূলত তাঁর হাত ধরেই দৈনিক পত্রিকায় ফিচার বিভাগ নিয়মিতভাবে চালু হয়। জীবদ্দশায় দৈনিক ভোরের কাগজ, দৈনিক আজকের কাগজ ও দৈনিক যায়যায়দিনে কর্মরত ছিলেন।
সঞ্জীব চৌধুরী ১৯৯৬ সালে সঙ্গীতশিল্পী বাপ্পা মজুমদারের সঙ্গে বর্তমানের শীর্ষস্থানীয় ব্যান্ড ‘দলছুট’ গঠন করেন। বাপ্পা মজুমদারের সঙ্গে দলছুট ব্যান্ড গড়ে অনেক জনপ্রিয় গান তিনি উপহার দিয়েছেন। ১৯৯৬ সালে দলছুট ব্যান্ড তাদের প্রথম অ্যালবাম ‘আহ’ প্রকাশ করে বেশ প্রশংসিত হয়। এরপর তাদের ‘হৃদয়পুর’, ‘আকাশচুরি, এবং ‘জোছনাবিহার’ অ্যালবাম থেকে একাধিক গান জনপ্রিয়তা পায়।
পরবর্তীতে সঞ্জীব চৌধুরীর কথা ও বাপ্পার সঙ্গীতায়োজন দলটিকে ভিন্ন মাত্রা দেয়। ধারাবাহিকসহ বেশ কয়েকটি নাটকেও তিনি অভিনয় করেছেন। লিখেছেন অনেক গল্প ও কবিতা। তার সুর ও গাওয়া জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে আছে ‘বায়োস্কোপ’, ‘আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিল চাঁদ’, ‘আমি তোমাকে বলে দিব’, ‘সাদা ময়লা রঙ্গিলা পালে আউলা বাতাস’, ‘চোখ’, ‘তখন ছিল ভীষণ অন্ধকার’, ‘আহ ইয়াসমিন’, ‘রিকশা’, ‘কথা বলব না’। তার গাওয়া বাউল শাহ আবদুল করিমের লেখা ‘গাড়ি চলে না’ এবং ‘কোন মেস্তরি বানাইয়াছে নাও’ গান দুটিও বেশ প্রশংসিত।