আগর চাষ শিখতে ১৫ কর্মকর্তার বিদেশ সফরের আয়োজন করা হচ্ছে। ‘সম্পূর্ণ বৃক্ষে উন্নত মানের আগর রেজিন সঞ্চয়ন প্রযুক্তি উদ্ভাবন’ শীর্ষক প্রকল্পে এসব বৈদেশিক সফরের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। প্রকল্পটি হাতে নিচ্ছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়।
জানা গেছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৭ কোটি ৯২ লাখ টাকা। এর মধ্যে ১৫ কর্মকর্তার বিদেশ সফরের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২ কোটি ৯০ লাখ টাকা। প্রশিক্ষণের জন্য যাবেন সাত কর্মকর্তা। এদের জন্য ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ২ কোটি ১২ লাখ। এ ছাড়া সেমিনার, কনফারেন্স, কর্মশালা বা স্টাডি ট্যুরে যাবেন আট কর্মকর্তা। এদের জন্য ব্যয় হবে ৫৯ লাখ ৩১ হাজার টাকা। এটি এখন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) আগামী সভায় উপস্থাপন করা হবে।
এর আগেও সরকারি প্রকল্পের আওতায় ঘাস, কাজুবাদাম, কফি ও আলু চাষ শেখাসহ নানা কারণে বিদেশ সফরের আয়োজন করা হয়েছিল। এটি বাস্তবায়িত হলে একটি বিশেষায়িত গবেষণাগার স্থাপনের মাধ্যমে কৃত্রিম পদ্ধতিতে স্বল্প সম্পূর্ণ বৃক্ষে উন্নত মানের আগর রেজিন সঞ্চয়নকারী কিট ও এর সফল প্রয়োগ পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কিন্তু এর আগে বিদেশ সফর প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেছিলেন, ‘এ ধরনের ব্যয় অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। পরিকল্পনা কমিশনকে বিশেষভাবে পর্যালোচনা করে দেখা উচিত, এমন ব্যয় জনগণের কোনো উপকারে আসবে কি না। যারা বিদেশে যাবেন তারা ফিরে এসে এই চাষগুলোতে কী ধরনের ভূমিকা রাখবেন সেটিই প্রশ্নসাপেক্ষ ব্যাপার।’ তবে উন্নয়ন প্রকল্পে বিদেশ সফর প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সাবেক সদস্য (সাবেক সচিব) জাকির হোসেন আকন্দ বলেন, ‘আমরা যখন প্রকল্পটি মূল্যায়ন করি তখন খুঁটিনাটি সবকিছুই খতিয়ে দেখি। একান্ত প্রয়োজন না হলে বিদেশ সফরের প্রস্তাব রাখা হয় না।’
পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রকল্পটি প্রস্তাব পাওয়ার পর ২০১৮ সালের ২০ ডিসেম্বর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় দেওয়া সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) পুনর্গঠন করা হয়েছে। এটি এখন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) আগামী সভায় উপস্থাপন করা হবে। অনুমোদন পেলে চলতি বছর থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম বলেন, ‘চলমান অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বন সাব-সেক্টরের উন্নয়নের জন্য যেসব নিয়ামকের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে সেগুলোর মধ্যে বনায়নের মাধ্যমে বনজ সম্পদ বৃদ্ধি ও প্রতিবেশ সংরক্ষণ অন্যতম। এ প্রকল্পের আওতায় প্রস্তাবিত আগর বাগান সৃজন কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব কমানো সম্ভব হবে।’
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আগর হলো অ্যাকুলারিয়া অথবা গ্রাইনোপোস গণভুক্ত বৃক্ষের কাঠের অভ্যন্তরে বাদামি হতে কালো রঙের এক প্রকার সুগন্ধি রেজিন সঞ্চয় করা সমৃদ্ধ কাঠের বিকল্প নাম। এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে প্রাপ্ত নন-টিম্বার শ্রেণির সবচেয়ে দামি দ্রব্য এটি। নানাবিধ গুণাবলি ও বহুমুখী ব্যবহারই মূলত আগর কাঠ ও তেলের ব্যাপক চাহিদা এবং অর্থনৈতিক গুরুত্ব ও মূল্যায়নের অন্যতম কারণ। সংক্রমণহীন, সুস্থ-সবল গাছের কাঠ সাধারণত সাদা, হালকা ও সুগন্ধহীন। কিন্তু যখন প্রাকৃতিক, বাহ্যিক বা অণুজীবের সংক্রমণের ফলে কাঠের মাঝে আগর রেজিন সঞ্চয়ন হয়, তখন এই কাঠ ধীরে ধীরে ভারী হতে থাকে এবং এক প্রকার মিষ্টি সুবাস বের হয়। এই মিষ্টি সুবাসিত কাঠই আগর নামে পরিচিত।
বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে গাছকে যান্ত্রিকভাবে আঘাত করা, বৃক্ষাভ্যন্তরে বিভিন্ন রাসায়নিক, বায়োলজিক্যাল ও বায়োকেমিক্যাল পদার্থের অনুপ্রবেশ করানোর মাধ্যমে আগর উৎপাদন করা হয়। এই প্রক্রিয়াগুলো অনেক ক্ষেত্রে কার্যকর হলেও গুণগত মানসম্পন্ন আগর উৎপাদনে অক্ষম এবং গাছের সামান্য অংশেই আগর রেজিন সঞ্চয়ন হয়। কারণ আগর চাষের সফলতা নির্ভর করে তার কার্যকর ইনুকোলেশন প্রযুক্তি তথা আগর সঞ্চয়নের পরিমাণের ওপর। সেজন্য একটি বিশেষায়িত গবেষণাগার স্থাপনের মাধ্যমে কৃত্রিম পদ্ধতিতে স্বল্প সময়ে সম্পূর্ণ বৃক্ষে উন্নত মানের আগর রেজিন সঞ্চয়নকারী কিট ও এর সফল প্রয়োগ পদ্ধতি উদ্ভাবন করা প্রয়োজন। এ ছাড়া বিদেশের বাজারে বাংলাদেশি আগর কাঠ, তেল ও আগরজাত পণ্যের সহজ প্রবেশার্থে মান পরীক্ষণ ও গুণগত মান নির্ধারণের ব্যবস্থা করা, উদ্ভাবিত আগর রেজিন সঞ্চয়ন প্রযুক্তি সংশ্লিষ্টদের মাঝে হস্তান্তরের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য দেশের তিনটি বিভাগের ছয়টি জেলায় বাস্তবায়নের প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে।
প্রকল্পের মূল কার্যক্রম হচ্ছে-গবেষণার মাধ্যমে কৃত্রিম পদ্ধতিতে আগর রেজিন সঞ্চয়নকারী কিট ও কিট প্রয়োগ পদ্ধতি উদ্ভাবন, আগর গবেষণার জন্য নতুন গবেষণাগার স্থাপন, গবেষণাগারে প্রয়োজনীয় বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি, আগর সঞ্চয়নে ন্যানোটেকনোলজি প্রয়োগ, অধিক উৎপাদনশীল এলাকায় পাঁচটি আগর সঞ্চায়ন পরীক্ষণ ক্ষেত্র স্থাপন, তিনটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনটি প্রদর্শনী প্লট স্থাপন, দক্ষ গবেষক ও সহায়ক জনবল নিয়োগ, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বর্তমান গবেষকদের মানোন্নয়ন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, গবেষণাগার ও মাঠপর্যায়ের কার্যক্রমের মাঝে গুরুত্ব দেওয়া, সনিক এবং আলট্রাসনিক শব্দতরঙ্গ ব্যবহারের মাধ্যমে সঞ্চয়ন পরিমাপন, উদ্ভাবিত প্রযুক্তি স্টেকহোল্ডারদের মাঝে হস্তান্তর, বৈদেশিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে গবেষণাবিষয়ক সমঝোতা চুক্তি সই, আগর গবেষণাবিষয়ক ফেলোশিপ দেওয়া এবং প্রভাবন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কম দামের সাদা আগর তেলকে অধিক মূল্যমানের কালো আগর তেলে রূপান্তর করা হবে।
এ বিষয়ে প্রকল্পটির দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সাবেক সদস্য (সাবেক সচিব) জাকির হোসেন আকন্দ বলেন, ‘প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় একটি বিশেষায়িত গবেষণাগার স্থাপনের মাধ্যমে কৃত্রিম পদ্ধতিতে কম সময়ে সম্পূর্ণ বৃক্ষে উন্নত মানের আগর রেজিন সঞ্চয়নকারী কিট ও এর সফল প্রয়োগ পদ্ধতি উদ্ভাবন করার কার্যক্রম নেওয়া হবে। এ ছাড়া বিদেশের বাজারে বাংলাদেশি আগর কাঠ, তেল ও আগরজাত পণ্যের সহজ প্রবেশার্থে মান পরীক্ষণ ও গুণগত মান নির্ধাণের ব্যবস্থা করাও এ প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে উদ্ভাবিত কৃত্রিম পদ্ধতিতে আগর রেজিন সঞ্চয়ন প্রযুক্তি সংশ্লিষ্টদের মাঝে হস্তান্তর সম্ভব হবে।’
Array