গত বছরের ১৮ আগস্ট, ময়মনসিংহের পাটগুদাম বাসস্ট্যান্ড ব্রিজ মোড়ে অচেতন অবস্থায় পড়েছিলেন এক ব্যক্তি। করোনা আতঙ্কের ওই সময়ে মানুষটির পাশে দাঁড়াননি কেউ। খবর পেয়ে ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার আহমার উজ্জামান সঙ্গে সঙ্গেই কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফিরোজ তালুকদারকে বিষয়টি সম্পর্কে জানার নির্দেশ দেন। ফিরোজ তালুকদার নিজেই ইউনিটসহ পৌঁছে যান ঘটনাস্থলে। পরে লোকটিকে পানি ও ফলের রস পান করানোর পর তার জ্ঞান ফিরে আসে।
জানা যায়, বাসের মাঝে অপরিচিত ব্যক্তির দেওয়া কোমল পানীয় পান করার পর সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। পরে তাকে বাসের হেলপার কৌশলে বাস থেকে নামিয়ে রাস্তার পাশে ফেলে রেখে যায়। দীর্ঘক্ষণ রাস্তার পাশে পরে থাকা লোকটি নড়াচড়া না করায় করোনার ভয়ে কেউ তার পাশে এসে দাঁড়ায়নি। কিন্তু পুলিশ গিয়ে তাকে উদ্ধার করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে।
এভাবেই করোনার দিনগুলোতে মানুষের পাশে থেকেছে ময়মনসিংহ পুলিশ। ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার আহমার উজ্জামানের নেতৃত্বে দুঃস্থ মানুষের কাছে খাবার পৌঁছানো, চিকিৎসা বঞ্চিতদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়া থেকে শুরু করে ওষুধ প্রদানসহ নানাভাবে মানুষের পাশেই ছিল তারা।
কোভিড-১৯ সংক্রমণ ধরা পড়ায় মধ্যরাতে একজন রোগীকে বাড়ি থেকে বের করে দেন নারায়ণগঞ্জের এক বাড়িওয়ালা। খবর পেয়ে গভীর রাতে সেখানে পুলিশ পৌঁছায় এবং তাকে বাড়িতে তুলে দিয়ে আসে। সেইসঙ্গে বাড়িওয়ালাকে বুঝানোর চেষ্টা করে এভাবে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে নয়, বরং স্বাস্থ্যবিধি মেনে করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
করোনাভাইরাসের উপসর্গ দেখা যাওয়ায় সাভারের আশরাফুজ্জামান নামের এক ব্যক্তিকে বাসায় একা রেখে চলে যান তার স্ত্রী ও সন্তান। নিরুপায় হয়ে তিনি একটি গাড়ি ভাড়া করে ঝিনাইদহে নিজ গ্রামে গিয়ে পৌঁছান। কিন্তু সেখানে গিয়েও তিনি বাড়িতে উঠতে পারেননি। জনপ্রতিনিধিদের কাছে খবর চলে যাওয়ায় তারা সেখানে তাকে থাকতে দেয়নি। পরবর্তী সময়ে ঝিনাইদহ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিজানুর রহমানের কাছে খবর পৌঁছলে তিনি আশরাফুজ্জামানের থাকার ব্যবস্থা করে দেন।
শুধুমাত্র এমন কিছু ঘটনাতেই নয়, কোভিড-১৯ সংক্রমণ বাংলাদেশে শনাক্তের পর থেকে বিভিন্ন স্থানে মানুষের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। সাধারণ ছুটি চলাকালে মানুষ যখন ঘর থেকে বের হতে পারতো না তখন তাদের বাড়িতে পরিচয় প্রকাশ করা ছাড়াই খাবার পৌঁছে দেওয়া থেকে শুরু করে হাসপাতালে চিকিৎসা নিশ্চিত করার কাজেও যুক্ত ছিল আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
করোনার পুরো সময়ে যখন লাশ দাফন করতেও স্বজনরা অনীহা জানাতেন ওই সময় সাধারণ মানুষের পাশে মানবিকতার হাত বাড়িয়ে দেয় দেশের আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি দেশের মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানার আহ্বান জানানোর কাজও করে গেছে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী।
সাধারণ ছুটি ঘোষণার পরে সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে দেশের নানাশ্রেণি পেশার মানুষের পাশে দাঁড়ায় বাংলাদেশ পুলিশ। এ সময় সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়ে দেশের খেটে খাওয়া দিনমজুররা। বিভিন্ন সচ্ছল পরিবারেও দেখা যায় অভাব-অনটন। এদের মধ্যে কেউ চাকরি হারিয়ে অসহায় আবার কেউবা সময় মতো বেতন না পেয়ে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে। এ সময় মানুষকে ঘরে থাকার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি তাদের ঘরে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যও পৌঁছে দেয় পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অসহায় মানুষের মাঝে খাদ্য বিতরণের কাজও করে এই বাহিনীর সদস্যরা।
সামাজিকভাবে যখন কোভিড-১৯ উপসর্গযুক্ত ব্যক্তিদের অবহেলা করা হচ্ছিল অনেক স্থানে তখন ত্রাতা হিসেবে ভূমিকা পালন করে বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরা। তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্থানে ওষুধ পৌঁছে দেওয়ার কাজও করে তারা। একইসঙ্গে করোনায় মৃতদের দাফনের কাজও করেছে পুলিশ। শুধুমাত্র একটি ফোন পেয়েই তারা সেবা দিতে ছুটে গেছে মানুষের পাশে।
এছাড়াও লকডাউনের সময় বিভিন্ন স্থানে মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি পৌঁছে দেয় বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরা। দেশে সাধারণ ছুটি শেষে যখন জীবনযাত্রা অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে আসে তখন থেকে ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ কর্মসূচি বাস্তবায়নেও কাজ করে যাচ্ছে পুলিশ। নানা স্থানে অভিযান ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছে এই বাহিনী।
এসব কাজ করতে গিয়ে এই বাহিনীর অনেক সদস্যই কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়। সর্বশেষ ৫ মার্চের তথ্যানুযায়ী, দেশে এ পর্যন্ত ১৬ হাজার ৫৬৪ জন পুলিশ সদস্যের কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। একই সময়ে দুই হাজার ৫২২ জন র্যাব সদস্যের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ ধরা পড়ে। এ পর্যন্ত ১৬ হাজার ৪২৪ জন পুলিশ সদস্য এবং দুই হাজার ৫০৯ জন র্যাব সদস্য সুস্থ হয়েছেন। একই সময়ে দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ৮৬ জন সদস্য। যারা কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে সেরে উঠেছেন তারাও প্লাজমা দান করে গেছেন কেন্দ্রীয় রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে। এখান থেকে প্লাজমা সরবরাহ করা হয়েছে দেশের সাধারণ জনগণের মাঝেও।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) গণমাধ্যম শাখার অতিরিক্ত উপ-কমিশনার ইফতেখারুল ইসলাম বলেন, ‘প্রথমদিকে যখন কোভিড-১৯ সংক্রমণ শুরু হয় তখন সারা বিশ্বের মতো আমরাও অনেক বিষয় পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারছিলাম না। যখন এটা আসে তখন সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে আমাদের মাঠে থাকতেই হয়েছে। লকডাউনে অনেকের বাসাতেই খাবার সংকট ছিল। আমরা সেখানেও ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেছি। এগুলো আমাদের কাজের মধ্যে পড়ে কিনা সেটা না ভেবে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি। এজন্য দেশের নাগরিক হিসেবে একটা দায়বদ্ধতা তো আছেই। তার পাশাপাশি মানবিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গাও রয়েছে। শুধুমাত্র দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজই নয় বরং কোভিড-১৯ মহামারীর সময়ে দেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানোটাও কিন্তু আমাদের দায়িত্ব ভেবেছি।’
তিনি বলেন, খেয়াল করে দেখবেন, গতবছরের এপ্রিল-মে মাসের দিকে মানুষের মাঝে এতটাই ভীতি কাজ করছিল যে, অনেকেই করোনায় মৃত স্বজনদের কাছেও আসছিল না। সে সময় জানাজা থেকে শুরু করে লাশ কবর দেওয়া পর্যন্ত প্রতিটি কাজেই কিন্তু পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা মানুষের পাশে ছিল। তিনি আরো বলেন, দেশে যখন সংক্রমণ বাড়ছিল তখন চিকিৎসকদের পাশাপাশি পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের কাজ করে যেতে হয়েছে। এক্ষেত্রে চিকিৎসকরা পিপিই পড়ে রোগীদের কাছে যাওয়ার জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কিছুটা সুযোগ পেলেও আমাদের সবার কিন্তু সে সুযোগ ছিল না। পিপিই পড়ে সারাক্ষণ মাঠে দায়িত্ব পালন করা আসলে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের পক্ষে অনেক সময়েই সম্ভব ছিল না।
ইফতেখারুল ইসলাম বলেন, লকডাউনের সময় মানুষ যেন শৃঙ্খলার মধ্যে থাকে সেগুলোও মানুষকে বোঝাতে হয়েছে। তখন কিন্তু এমন অনেক বিষয়েই মানুষের পাশে আমাদের যেতে হয়েছে। আর এ কারণেই পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের মাঝে সংক্রমণের মাত্রাটা বেশি ছিল। তিনি বলেন, আমাদের আইজিপি ড. বেনজির আহমেদ স্যার এবং একই সময়ে আমাদের কমিশনারদের নেওয়া উদ্যোগ সবাইকে অনুপ্রাণিত করেছে। রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালকে একটি উন্নত হাসপাতাল হিসেবে রূপান্তর করা হয়েছিল, যাতে সেখানে কোভিড-১৯ সংক্রমিতদের চিকিৎসা দেওয়া যায়। একইসঙ্গে ইমপালস হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছিল চিকিৎসার জন্য। এ কারণে দেখা গেছে বাহিনীর সাধারণ সদস্যদের মাঝেও মনোবল অনেক বেড়ে গিয়েছিল। দেখা গেছে, একজন কনস্টেবল যখন আক্রান্ত হতেন তখন তিনি তেমন চিকিৎসাই পেয়েছেন যেমনটা পেয়েছেন ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা। তিনি আরো বলেন, প্রতিটি বিভাগে ফোকাল পয়েন্ট অফিসার ছিল, যারা প্রতিনিয়ত ফোর্সের সদস্যদের মনোবল বাড়ানোর জন্য কথা বলে গেছেন, উদ্বুদ্ধ করেছেন, কাউন্সিলিং করেছেন। সদস্যদের বাসায় যারা আক্রান্ত হয়েছে তাদের মাঝে খাওয়া পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। একইসঙ্গে সাধারণ নাগরিকদের মাঝে যারা লজ্জায় কিছু বলতে পারছিলেন না তাদের বাসায়ও নীরবে-নিভৃতে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। আর এগুলো সম্ভব হয়েছে টিম স্পিরিটের জন্য।
ইফতেখারুল ইসলাম বলেন, খেয়াল করলে দেখা যাবে পুলিশের মাঝে আক্রান্তের হার বেশি হলেও সুস্থ হওয়ার পরিমাণও ছিল বেশি। এক্ষেত্রে দেখা গেছে, আমাদের কেউ একজন আক্রান্ত হলে ফোকাল পয়েন্ট হিসেবে যিনি দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি সঙ্গে সঙ্গে তাৎক্ষণিক অ্যাম্বুলেন্স ব্যবস্থা করে চিকিৎসার সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। যখনই কারো অবস্থা খারাপের দিকে গেছে সঙ্গে সঙ্গে তাকে আইসিইউ ও সিসিইউতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে চমৎকার একটা কো-অর্ডিনেশন ছিল। সামনের দিনগুলোতেও আমরা এভাবে সেবা দিয়ে যাব অবশ্যই।
তিনি বলেন, করোনায় এখন পর্যন্ত আমাদের ৮৬ জন সদস্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। এত মৃত্যুর পরে অনেকেই যেখানে পাজল হয়ে গিয়েছিলেন সেখানে আমরা কিন্তু থেমে থাকিনি। আমাদের ডিসি, এসি, এডিসি এবং আরো উপরে জয়েন্ট কমিশনার, অ্যাডিশনাল কমিশনার থেকে শুরু করে সবাই মাঠে কাজ করেছেন সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে। এক্ষেত্রে যারা মাঠ পর্যায়ে ছিলেন তারা উৎসাহিত হয়েছে এই ভেবে যে, আমাদের সিনিয়ররা যেহেতু মাঠে আছেন সেহেতু আমরাও মাঠে থাকব। এই অনুপ্রেরণা আমাদের সবার মধ্যে কাজ করেছে।
ভবিষ্যত দিনগুলিতেও একইভাবে সেবা দিয়ে যাবেন জানিয়ে ইফতেখারুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের অনেক সদস্যই ভ্যাকসিন নিয়েছে। এসব প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই আমাদের সামনের দিনগুলোতেও চলতে হবে। এক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি, যে কোনো পরিস্থিতিই আসুক না কেন বাংলাদেশ পুলিশ কখনো পিছিয়ে যাবে না। কঠিন যে সময় ছিল আমরা হয়তোবা সেটি পার করেছি। এখন মানুষ আক্রান্ত হলেও হয়তো তা সীমিত মাত্রায় হবে। ভ্যাকসিন নেওয়ার পরেও আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলব। তারপরেও যদি কোনো নতুন চ্যালেঞ্জ দেখা দেয় সেটি আমরা সমান গুরুত্ব দিয়ে মোকাবিলা করে যাব।’
Array