• ঢাকা, বাংলাদেশ

গভীর সংকটে পড়তে যাচ্ছে ব্যাংক খাত 

 admin 
10th Nov 2020 11:07 pm  |  অনলাইন সংস্করণ

করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও ব্যাংক খাত সংকটে পড়তে যাচ্ছে। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য সরকার প্রায় ১৯ ধরনের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এই প্যাকেজগুলোর মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়িদের জন্য মূলধন যোগান দেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে এই সংকটের মধ্যে ঋণের কিস্তি না দিলে সেই ঋণকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না এই মর্মে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আর এই সুযোগটি গ্রহণ করছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। ফলে ঋণ প্রবাহ বাড়লেও কিস্তি আদায় হচ্ছে না। ব্যাংক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, করোনায় প্রায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ কিস্তি আদায় কমেছে। অর্থাৎ ঋণ বিতরণ বাড়লেও আদায় কমেছে। এতে ব্যাংক খাত গভীর সংকটে পড়তে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা।

জানা গেছে, করোনার কারণে জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ঋণ শ্রেণীকরণে স্থগিতাদেশ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থাৎ এই সময়ের মধ্যে কোন গ্রাহক ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে সেই ঋণকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না। করোনার প্রকোপ দীর্ঘায়িত হওয়ায় গত ১৫ জুন আরও তিন মাস বৃদ্ধি করে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছিল। এরপর সম্প্রতি সেই সময় আরও তিন মাস বৃদ্ধি করা হয়েছে। এর ফলে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণের কিস্তি না দিলেও চলবে। কিস্তি না দিলে কেউ ঋণ খেলাপি হবে না। আবার এই সময়ে ঋণের ওপর কোন ধরনের দন্ড সুদ বা অতিরিক্ত ফি আরোপও করা যাবে না। তবে যদি কেউ ঋণ শোধ করে নিয়মিত গ্রাহক হন, তাকে খেলাপি গ্রাহকের তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। এতে কিছু অসাধু গ্রাহক সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ঋণের কিস্তি পরিশোধ করছে না।

এ প্রসঙ্গে অগ্রণী ব্যাংকের এমডি ও সিইও মোহম্মদ শামস-উল ইসলাম বলেন, ‘সরকার উদারতা দেখিয়ে কিস্তি না দিলেও খেলাপি করা যাবে না এই মর্মে নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু এই যেমন প্রকৃত ভুক্তভোগীরা গ্রহণ করছে। তেমনি গ্রহণ করছে অসাধু ব্যবসায়ীরাও। এসব গ্রাহককে আমরা বোঝানোর চেষ্টা করছি। বলছি, আপনি এখন দিলেও দিতে হবে, পরে দিলেও দিতে হবে, তাহলে এখন দিচ্ছেন না কেন? এটাও বলছি, আপনি নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করলে ১০ শতাংশ রিবেট পাবেন। কেউ আমাদের কথা শুনে কিস্তি দিচ্ছে। কেউ দিচ্ছে না। করোনার মধ্যে কিস্তি আদায় হচ্ছে মাত্র ৩০ শতাংশের মতো।’

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘করোনার আগে যে পরিমাণ কিস্তি আদায় হতো তার চেয়ে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ কিস্তি আদায় কমেছে। এখন আদায় হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। আর কিস্তি আদায় না হলেও খেলাপি করা যাবে না প্রকৃত ভুক্তভোগীদের ঋণে। কিন্তু এই সুযোগ নিয়ে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ইচ্ছাকৃত কিস্তি দিচ্ছে না। এক সময় এই ঋণগুলো বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে।’

ব্যাংক খাত এমনিতেই খেলাপি ঋণে জর্জরিত, তারপরও এতো সুযোগ দিলে খাতটি আরও সংকটে পড়বে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা। এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ এবি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম  বলেন, ‘নিয়ম বহির্ভূত এসব সুবিধা দেয়ার কারণে ব্যাংক খাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। সরকার যে কারণে এই সুযোগ দিচ্ছে তার অপব্যবহার হচ্ছে। কিস্তি না দিলে ব্যাংকের আয় কমবে এবং খেলাপি ঋণ বেড়ে যাবে। এতে গভীর সংকটে পড়বে বড় খাতটি। করোনার মধ্যে ব্যবসায়ীদের ব্যবসা যেহেতু খারাপ যাচ্ছে, সেজন্য এই সুবিধা দেয়া হয়েছে। কিন্তু এতে দেখা যাবে, প্রকৃত ভুক্তভোগী ঋণের কিস্তি পরিশোধ করবে। আর যাদের খেলাপি করার ইচ্ছা আছে, তারা কিস্তি পরিশোধ করবে না। গুড গভর্নেন্স না থাকলে এমনই হবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২০ সালের জুন মাস শেষে দেশের ৫৯টি ব্যাংক মোট ১০ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। এরমধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৬ হাজার ১১৬ কোটি টাকা। গত মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ২৪ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা। খেলাপির পরিমাণ ছিল ৯২ হাজার ৫১০ কোটি টাকা। গত বছরের ডিসেম্বরে ১০ লাখ ১১ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপির অঙ্ক ছিল ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ। গত বছরের মার্চ মাস শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা। ওই সময়ে বিতরণ করা ৯ লাখ ৩৩ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা ঋণের ১১ দশমিক ৮৭ শতাংশ ছিল খেলাপি। আন্তর্জাতিকভাবে খেলাপি ঋণের হার ৩ শতাংশের বেশি থাকলেই ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয়। সেখানে বাংলাদেশে আছে ৯ শতাংশের বেশি। এতে এমনিতেই ঝুঁকিতে রয়েছে ব্যাংকিং খাত। এর মধ্যে করোনার মহামারীর কারণে ঋণের কিস্তি আদায় না হলেও খেলাপি হিসেবে ধরা না হওয়ার কারণে অদৃশ্য খেলাপি ঋণের পরিমাণ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এছাড়া সম্প্রতি বৃহৎ ও ছোট শিল্পের করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ৫০ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা ঋণ ঘোষণা করা হয়েছে। এই ঋণেও খেলাপি হওয়ার আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা।

এ প্রসঙ্গে গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ব্যাংক খাতের অবস্থা ভালো না। খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। সেহেতু এই সুযোগটা ব্যাংক বা গ্রাহক কারও জন্যও ভালো নয়। তবে করোনার মধ্যে এই সুবিধা অন্য দেশও দিয়েছে। তবে এখানে ব্যাংলাদেশ ব্যাংক কিছুটা কৌশলী হতে পারতো। যেমন করোনার মধ্যে যেসব খাতের ব্যবসা খারাপ হয়েছে তাদের দিতে পারতো। আর যাদের ব্যবসা ভালো যাচ্ছে তাদের না দিতে পারতো। ওষুধ, সুরক্ষা সামগ্রি তৈরিকারক গার্মেন্টেসের অবস্থা ভালো। তাই এসব খাতে এই সুবিধা না দিলেও হতো। আবার যাদের অবস্থা খারাপ, তাদের এই সুবিধা দেয়া উচিত ছিল। সম্প্রতি ভারতও এমনটা করেছে। তারাও সুবিধা দিয়েছে, তবে সব খাতে নয়। কারণ এই সুবিধা নিয়ে কিছু অসাধু গ্রাহক ইচ্ছা করেই ঋণের কিস্তি পরিশোধ করবে না এবং ঋণগুলো খেলাপি হয়ে যাবে কিন্তু খেলাপির খাতায় উঠবে না। এতে বড় ধরনের সমস্যায় পড়বে ব্যাংক খাত।’

কিস্তি আদায় কম হওয়ায় ঋণ ও সুদ আদায় কমে গেছে। এতে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংকসহ সরকারি-বেসরকারি অধিকাংশ ব্যাংকের আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে বাড়ছে লোকসানি শাখাও। জানা গেছে, চলতি বছরে সোনালী ব্যাংক ২৫০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করেছিল। তবে জুন পর্যন্ত আদায় হয়েছে মাত্র ৫ কোটি টাকা। জনতা ব্যাংকের ১ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায়ের লক্ষ্যের বিপরীতে আদায় করেছে আড়াই কোটি টাকা। সোনালী ব্যাংকের লোকসানি শাখা ২৭ থেকে বেড়ে হয়েছে ৫০টি। জনতা ব্যাংকের লোকসানি শাখা ৫০ থেকে বেড়ে হয়েছে ৭৯। বছরের প্রথম ৬ মাসে ব্যাংকটি ৩ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা নিট লোকসান করেছে। অথচ গত বছরে ২৫ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল তারা। অবশ্য সোনালী ব্যাংক চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে মাত্র ৯৫ কোটি টাকা নিট মুনাফা করেছে। পুরো বছরে রূপালী ব্যাংক খেলাপি ঋণ থেকে ৩৫০ কোটি টাকার লক্ষ্যের বিপরীতে আদায় করেছে দেড় কোটি টাকা। ব্যাংকটির লোকসানি শাখা ১১ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৬টি। অগ্রণী ব্যাংক খেলাপি ঋণের বিপরীতে ২০০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করলেও আদায় করেছে সাড়ে ৬ কোটি টাকা। আর লোকসানি শাখা বেড়ে হয়েছে ১৮ থেকে ৭৮। প্রথম ৬ মাসে নিট মুনাফা করেছে মাত্র ১৫ কোটি টাকা, গত বছরের পুরো সময়ে হয়েছিল ১০৭ কোটি টাকা।

সরকারি হিসেবে খেলাপি ঋণ ৯৬ হাজার কোটি টাকা বলা হলেও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) জানিয়েছে বাংলাদেশের প্রকৃত খেলাপি ঋণ তিন লাখ কোটি টাকা। সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে সংস্থাটি এই তথ্য জানায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৯-২০১১ সাল পর্যন্ত খেলাপি ঋণ উল্লেখযোগ্য হারে ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেলেও পরবর্তী সময়ে খেলাপি ঋণের হার পুনরায় বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৯ সালের শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা, যা ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে বেড়ে দাঁড়ায় এক লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১০ বছরে বৃদ্ধি ৪১৭ শতাংশ। এ সময়ে প্রতিবছর গড়ে ৯ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) একটি প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে টিআইবি দাবি করেছে, ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ ছিল দুই লাখ ৪০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা। এর সঙ্গে অবলোপনকৃত খেলাপি ঋণ ৫৪ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা যোগ করলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, খেলাপি ঋণ হ্রাসে যথাযথ পদক্ষেপ না নেয়ায় এবং ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের আইনের আওতায় না আনায় দিন দিন ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। গত ১০ বছরে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৪১৭ শতাংশ। খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে বলেও মন্তব্য করেছে সংস্থাটি। সেই সঙ্গে ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ ও ব্যাপক অনিয়মে জর্জরিত ব্যাংকিং খাত সংস্কারের জন্য এ খাতসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠনসহ ১০টি সুপারিশ করা হয়।

Array
We use all content from others website just for demo purpose. We suggest to remove all content after building your demo website. And Dont copy our content without our permission.
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
এই বিভাগের আরও খবর
 
Jugantor Logo
ফজর ৫:০৫
জোহর ১১:৪৬
আসর ৪:০৮
মাগরিব ৫:১১
ইশা ৬:২৬
সূর্যাস্ত: ৫:১১ সূর্যোদয় : ৬:২১