
ভুয়া পরিচয়পত্র তৈরির ছড়াছড়ির কারণে বর্তমানে দেশে ডাবল এনআইডিধারী লোকের সংখ্যা ২ লাখের বেশি ছাড়িয়ে গেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিশেষ করে দ্বৈত জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে সাহেদ, ডা. সাবরিনার করোনার ভুয়া সনদ প্রদান ও বেশ কয়েকটি স্থানে অন্যের সম্পত্তি বিক্রি করে দেয়ার ঘটনায় আলোচনার ঝড় ওঠে দেশজুড়ে।
এনআইডি জালিয়াতদের ধরতে তৎপর হয় নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও এর অধীন প্রতিষ্ঠান জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগ। সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয় রাজধানীসহ দেশজুড়ে। এতে কেঁচো খুড়তে গিয়ে বেরিয়ে আসে সাপ। খোঁজ নিতে গিয়ে প্রায় ২ লাখ ৭ হাজার লোকের দ্বৈত এনআইডির সন্ধান পাওয়া গেছে।
জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগ জানায়, এসব দ্বৈত এনআইডির মালিকদের মধ্যে এরইমধ্যে ৯২৭ জনের জাতীয় পরিচয়পত্র ব্লক করে দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ভোটার তালিকা আইন, ২০০৯ এর ধারা ১৮ এবং জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০১০ এর ধারা ১৪ ও ১৫ অনুসারে নির্বাচন কমিশন ফৌজদারি মামলা দায়ের করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
এছাড়া জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) জালিয়াতিতে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। সমূলে বিনাশ করা হবে জালিয়াতদের। যত বড় পদমর্যাদার কর্মকর্তাই হোন না কেন, ছাড় দেয়া হবে না কাউকেই।
এদিকে ভোটার তালিকায় রোহিঙ্গা অন্তর্ভুক্তি ঠেকাতে বিশেষ কমিটি গঠন করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। প্রায় ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার বায়োমেট্রিক তথ্যসহ আলাদা রোহিঙ্গা ডাটাবেজ স্থাপন করা হয়েছে। এখন চলছে অবৈধদের খুঁজে বের করার অনুসন্ধান। কোনোভাবেই এদের বাংলাদেশি হিসেবে ভোটার করা হবেনা।
জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন (এনআইডি) অনুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাইদুল ইসলাম বৃহস্পতিবার থানা ও উপজেলা নির্বাচন অফিস, এবং আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসসহ সারাদেশে জাতীয় পরিচয়পত্র সেবার মান বাড়াতে এবং এসব অপরাধ নির্মূলে গৃহীত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি অবহিত করেন।
তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যে ২ লাখ ৭ হাজার দ্বৈত ভোটার শনাক্ত করেছি। সবার বিষয়গুলো আমরা অবজার্ভ (পর্যবেক্ষণ) করছি। আমরা দেখছি, উদ্দেশ্য কী ছিলো? তবে আমরা সবার বিরুদ্ধে মামলা করিনি, করবো না। যারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে এটি করেছে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করব। তবে কেউ যদি সে বিষয়ে কমিশনে আবেদন করেন, সেটি আমরা যাচাই-বাছাই করে কারণ জানব যে কোন উদ্দেশে তারা এটি করেছে। সেটি আমরা কমিশনকে অবহিত করে ব্যবস্থা নেব। যারা দ্বৈত ভোটার হয়েছেন আমরা তাদের নোটিফাইড করছি। এসএমএসের মাধ্যমেও তাদের জানিয়ে দিচ্ছি।
দ্বৈত ভোটার নিবন্ধন রোধে গৃহীত পদক্ষেপের বিষয়ে জানিয়ে তিনি বলেন, দ্বৈত ভোটার পাওয়া গেলে প্রাথমিকভাবে বিধি মোতাবেক প্রথমটি রেখে পরবর্তী ভোটার তথ্য ব্লক করে দেয়া হয়। উদ্দেশ্যমূলকভাবে তথ্য গোপন করে দ্বৈত ভোটার হওয়ার প্রমাণ পাওয়ায় ইতোমধ্যে ৯২৭ জনের এনআইডি লক করাসহ ভোটার তালিকা আইন, ২০০৯ এর ধারা ১৮ এবং জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০১০ এর ধারা ১৪ ও ১৫ অনুসারে নির্বাচন কমিশন ফৌজদারি মামলা দায়ের করার নির্দেশনা দিয়েছে। এছাড়াও জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০১০ এর ধারা ১৬ ও ১৭ অনুযায়ী দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা/কর্মচারী দায়িত্বে অবহেলা করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এনআইডি জালিয়াতদের নির্মূলের আলটিমেটাম: অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে এনআইডির ডিজি বলেন, এনআইডি জালিয়াতিতে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আমরা ইতিমধ্যে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। সম্প্রতি ঢাকায় এনআইডি জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত আইডিইএ প্রকল্পের আউটসোর্সিং ডাটা এন্ট্রি অপারেটর দুইজনকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন অনৈতিক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় গত ৮ বছরে সর্বমোট ৩৯ জনকে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করা হয় এবং কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। আমরা কোনো জালিয়াতকারীকে ছাড় দেবো না।
তথ্য গোপন করে দ্বৈত ভোটার হওয়ায় ডা. সাবরিনার বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ডা. সাবরিনা শারমিন হুসেনের দুইটি এনআইডি লক করা হয়েছে। একইসঙ্গে গুলশান থানা নির্বাচন অফিসারকে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০১০ এর ধারা ১৪ ও ১৫ অনুযায়ী মামলা করার নির্দেশনা প্রদান করা হয় এবং ৩০ আগস্ট বাড্ডা থানায় মামলা দায়ের করা হয়। ডা. সাবরিনা শারমিন হুসেন কিভাবে দুই বার ভোটার হয়েছেন এবং তার সাথে কেউ জড়িত আছে কিনা তা পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে তদন্তের জন্য বিসিসি ও বুয়েট প্রতিনিধিসহ আইটি বিশেষজ্ঞ নিয়ে ৬ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
কুষ্টিয়ায় এনআইডি জালিয়াতির বিরুদ্ধে গৃহিত পদক্ষেপ প্রসঙ্গে এনআইডির ডিজি বলেন, আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তার মধ্যে এটি তদন্ত করা হয় এবং প্রাপ্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ৬ জন ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র ব্লক করা হয়। কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক অধিকতর তদন্ত শেষে প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। এর ক্রমধারায় অধিকতর তদন্তের জন্য নির্বাচন কমিশনের একজন যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বে চার সদস্য বিশিষ্ট আরো একটি তদন্ত কমিটি গ্রহণ করা হয়েছে। সেই তদন্তগুলোর সুপারিশের ওপর ভিত্তি করে কোনো কর্মকর্তা/কর্মচারী অভিযুক্ত প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কমিশন নির্দেশনা প্রদান করেছেন।
দেশব্যাপী এনআইডি কার্যক্রম তদারকিতে সাঁড়াশি অভিযান চলবে জানিয়ে সাইদুল ইসলাম বলেন, ঢাকা জেলায় সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনার জন্য পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট চার চারটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ঢাকার প্রতিটি থানায় অভিযান চালানো হয়েছে। পর্যায়ক্রমে দেশব্যাপী ১০টি টিমের মাধ্যমে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করা হবে। এই অভিযান নিয়মিত চলবে। প্রতি মাসে এই কমিটি জেলা উপজেলায় অভিযানে যাবে এবং সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করবে। কেউ অপরাধ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এদিকে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন (এনআইডি) অনুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাইদুল ইসলাম জানান, ভোটার তালিকায় রোহিঙ্গা অন্তর্ভুক্তি ঠেকাতে বিশেষ কমিটি করা হয়েছে। প্রায় ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার বায়োমেট্রিক তথ্যসহ আলাদা রোহিঙ্গা ডাটাবেজ স্থাপন করা হয়েছে। তিনি জানান, অবৈধভাবে রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি অনুসন্ধানে একটি টিম পাঠানো হয়। পরবর্তীতে অনুসন্ধান টিমের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে অধিকতর তদন্তের জন্য ৮ সদস্য বিশিষ্ট একটি কারিগরি কমিটি এবং একটি প্রশাসনিক কমিটি গঠন করা হয়।
কমিটিতে বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের প্রতিনিধি রয়েছে। অধিকতর তদন্তের সুবিধার্থে একজন যুগ্ম-সচিবের নেতৃত্বে প্রশাসনিক কমিটি গঠন করা হয়। উভয় কমিটিতে বহিঃসংস্থার সদস্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
Array