হযরত ওয়ায়েস করণী (রাঃ)। যিনি নিবেদিত প্রাণে আপন অসুস্থ মায়ের খেদমত করেছেন। মায়ের প্রতি তাঁর অকৃতিম ভালবাসা ও নিবেদিত সেবায় পরম করুনাময় আল্লাহতায়ালা তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তাকে এলমে মারেফত দান করেন।
সেই ওয়ায়েস করনী (রাঃ) নবীজী (সাঃ)কে চর্মচক্ষুতে না দেখেও নিজ প্রাণাপেক্ষা ভালবাসতেন। যখন শুনলেন, উহুদের যুদ্ধে নবীজীর (সাঃ) দন্ত মোবারক শহীদ হয়েছে-তিনি এমন ব্যথিত হলেন যে পাথরের আঘাতে নিজের ১টি দাঁত ভেংগে ফেললেন। নবীজী না জানি কত কষ্ট পেয়েছেন- যে কষ্ট নিজ সত্তায় উপলব্ধি করার জন্য নিজেই নিজের দাঁত ভেংগে ফেললেন। কিন্তু যেটা ভাংলেন, নবীজীর (সাঃ) সেটা ভেংগেছে কিনা -তিনিতো জানেন না। তাই একে একে ৩২ দাঁত ভেংগে ফেললেন। চোখে না দেখেও প্রেমের এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। তাইতো আশেকে রাসূল বা রাসূল প্রেমিক উপাধি পেলেন।
ওয়ায়েস করনীর (রাঃ) নবী-প্রেম রাসূল (সাঃ) এর নিকট অজানা ছিল না। তাইতো তিনি হযরত উমর (রাঃ) এর মত উচুস্থরের সাহাবীদের নিকট হযরত ওয়ায়েস করনীর ভূয়সী প্রশংসাসহ পরিচয় চিহ্ন বর্ণনা করে তার নিকট মাগফেরাতের দু‘আ কামনার জন্য (দু‘আ করার সুপারিশ) তাঁদেরকে নির্দেশ দিলেন। মুসলিম শরীফের হাদীসে তার বর্ণনা দেখুন–
১। যুহায়র ইব্ন হারব (রাঃ)…উসায়র ইব্ন জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, কূফায় একটি প্রতিনিধি দল উমর (রাঃ)-এর কাছে এলো। তাদের মধ্যে এমন এক ব্যক্তিও ছিল, যে সে ওয়ায়েস (রঃ)-কে উপহাস করত। তখন উমর (রাঃ)বললেন, এখানে কারানী গোত্রের কোন লোক আছে কি? তখন সেই লোকটি এলো। এরপর উমর (রাঃ) বললেন, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেছেনঃ তোমাদের কাছে ইয়ামান থেকে এক ব্যক্তি আসবে, যে ওয়ায়েস নামে পরিচিত। ইয়ামানে তাঁর মা ব্যতীত কেউ থাকবে না। তার শ্বেতরোগ হয়েছিল। সে আল্লাহ্র কাছে দু‘আ করার বদৌলতে আল্লাহ্ তাকে শ্বেত রোগ মুক্ত করে দেন। তবে মাত্র এক দীনার অথবা এক দিরহাম পরিমাণ স্থান বাকী থাকে। তোমাদের মধ্য থেকে যদি কেউ তাঁর সাক্ষাৎ পায় সে যেন তোমাদের জন্য (তাঁর কাছে) মাগফিরাতের দু‘আ কামনা করে। (মুসলিম শরীফ, হাদিস নং- ৬২৫৯ ইফা)।
২। যুহায়র ইব্ন হারব ও মুহাম্মদ ইব্ন মুসান্না (রঃ)…উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, অবশ্যই তাবিঈনগণের মধ্যে সেই ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ যে ওয়ায়েস নামে পরিচিত। তাঁর একমাত্র মা আছেন এবং তাঁর শ্বেত রোগ হয়েছিল। তোমরা তাঁর কাছে অনুরোধ করবে যেন সে তোমাদের মাগফিরাতের জন্য দু‘আ করে।(তথা আল্লাহর নিকট ক্ষমার জন্য সুপারিশ করে)।(মুসলিম শরীফ, হাদিস নং- ৬২৬০ ইফা)।
৩। ইসহাক ইব্ন ইবরাহীম হানযালী, মুহাম্মদ ইব্ন মুসান্না ও মুহাম্মদ ইব্ন বাশ্শার (রঃ)….উসায়র ইব্ন জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, উমর ইব্ন খাত্তাব (রাঃ)-এর নিয়ম ছিল, যখন ইয়ামানের কোন সাহায্যকারী সেনাদল তাঁর কাছে আসত তখন তিনি তাঁদের জিজ্ঞাসা করতেন, তোমাদের মধ্যে কি ওয়ায়েস ইব্ন আমির আছে? অবশেষে তিনি ওয়ায়েসকে পান। তখন তিনি বললেন, তুমি কি ওয়ায়েস ইব্ন আমির? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, মুরাদ গোত্রের কারান বংশের? তিনি বললেন, হ্যাঁ। জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার মা আছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তখন উমর (রাঃ) বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন: ‘‘তোমাদের কাছে মুরাদ গোত্রের কারান বংশের ওয়ায়েস ইব্ন ‘আমির ইয়ামেনের সাহায্যকারী সেনাদলের সঙ্গে আসবে। তাঁর ছিল শ্বেত রোগ। পরে তা নিরাময় হয়ে গিয়েছে কেবলমাত্র এক দিরহাম ব্যতিরেকে। তাঁর মা রয়েছেন। সে তাঁর প্রতি অতি বাধ্য (সেবাপরায়ণ)। সে এমন ব্যক্তি যে আল্লাহ্র উপর ভরসা করে কসম করলে আল্লাহ্ তা পূর্ণ করে দেন। কাজেই যদি তুমি তোমার জন্য তার কাছে মাগফিরাতের দু‘আ কামনার সুযোগ পাও তাহলে তা করবে।” সুতরাং আমার জন্য মাগফিরাতের দু‘আ কর। তখন ওয়ায়েস (রঃ) তাঁর মাগফিরাতের জন্য দু‘আ করলেন।এরপর উমর (রাঃ) তাঁকে বললেন, তুমি কোথায় যেতে চাও? তিনি বললেন, কূফা এলাকায়। উমর (রাঃ) বললেন, আমি কি তোমার জন্য কূফার গভর্ণরের কাছে চিঠি লিখে দেব? তিনি বললেন, আমি সাধারণ গরীব মানুষের মধ্যে থাকাই পছন্দ করি। বর্ণনাকারী বলেন, পরবর্তী বছরে তাঁদের অভিজাত লোকদের মধ্যে এক ব্যক্তি হজ্জ করতে এলো এবং উমর (রাঃ)-এর সংগে তাঁর সাক্ষাৎ হল। তখন তিনি তাকে ওয়ায়েস কারানী (রঃ)-এর অবস্থা সম্পকে জিজ্ঞাসা করলেন। সে বলল, আমি তাঁকে জীর্ণ ঘরে সম্পদহীন অবস্থায় রেখে এসেছি। তিনি বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, তিনি বলেছেনঃ তোমাদের কাছে মুরাদ গোত্রের কারান বংশের ওয়ায়েস ইব্ন আমির (রাঃ) ইয়ামেনের সাহায্যকারী সেনাদলের সঙ্গে আসবে। তাঁর শ্বেত রোগ ছিল। সে তা থেকে আরোগ্য লাভ করে, এক দিরহাম পরিমাণ স্থান ব্যতীত। তাঁর মা রয়েছেন, সে তাঁর প্রতি সেবাপরায়ণ। যদি সে আল্লাহ্র নামে কসম খায় তবে আল্লাহ্ তা’আলা তা পূর্ণ করে দেন। তোমরা নিজের জন্য তাঁর কাছে মাগফিরাত-এর দু‘আ চাওয়ার সুযোগ পেলে তা করবে। পরে অভিজাত সে ব্যক্তি ওয়ায়েস (রঃ)-এর কাছে এল এবং বলল, আমার জন্য মাগফিরাত-এর দু‘আ করুন। তিনি বললেন, আপনি তো নেক সফর (হজ্জের সফর) থেকে অদ্য আগত। সুতরাং আপনি আমার জন্য মাগফিরাতের দু‘আ করুন। সে ব্যক্তি বলল, আপনি আমার মাগফিরাতের দু‘আ করুন।এরপর তিনি বললেন, আপনি কি উমর (রাঃ)-এর সাক্ষাৎ লাভ করেছেন। সে বলল, হ্যাঁ। তখন তিনি তাঁর জন্য মাগফিরাতের দু‘আ করলেন। তখন লোকেরা তাঁর (মর্যাদা) সম্পর্কে অবহিত হল। তারপর তিনি যে দিকে মুখ সে দিকে চললেন (আর্থাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন)। উসাইর (রঃ) বলেন, আমি তাঁকে একখানি ডোরাদার চাদর (পরিধেয়রূপে) দিয়েছেলাম। এরপর যখন কোন ব্যক্তি তাঁকে দেখত তখন বলত, ওয়ায়েস (রঃ)-এর এই চাদরখানি কোথায় গেল? (মুসলিম শরীফ, হাদিস নং- ৬২৬১ ইফা)।
হাদীসের বিবরণ থেকে যা আমরা শিক্ষা পাইঃ
১। নবীজী (সাঃ) ছাড়াও আল্লাহ্র ওলীগণ সুপারিশ করতে পারেন।
২।নবীজী (সাঃ) এলমে গায়েব জানতেন, কিন্তু আমরা জানি না। আল্লাহতায়ালা প্রয়োজন অনুযায়ী তাঁকে গায়েবের খবর দিতেন। কাজেই তিনি আমাদের মত সাধারণ মানুষ নয়, যদিও আকার-আকৃতিতে ও চেহারা-সুরতে আমাদের মতই।
হযরত ওয়ায়েস করনী (রঃ) এর ১০টি উপদেশঃ-
১. যে ব্যক্তি আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলকে চিনতে পেরেছে, তাঁর কাছে দুনিয়ার কোনো কিছু গোপন নেই ।
২.যে লোকের কাছে এ তিনটি জিনিস সবচেয়ে প্রিয়, দোযখ তার সবচেয়ে কাছে । (ক) সবচেয়ে ভাল খাবার খাওয়া (খ) সবচেয়ে ভাল কাপড় পরিধান করা (গ) বড় লোকদের সাথে চলাফেরা ও উঠাবসা করা ।
৩. মনকে সব সময় আল্লাহ্ তা’আলার দিকে রাখবে, তাহলে শয়তান মনের মধ্যে স্থান পাবে না।
৪.নিরিবিলি বসে আল্লাহকে ডেকে মনে য শান্তি পাওয়া যায়, দুনিয়ার অন্য কোনো জিনিস মানুষের মনে সে রকম শান্তি দিতে পারে না ।
৫. প্রতিদিন সকালে বিছানা থেকে উঠে মনে করবে যে, আজই আমার জীবনের শেষ দিন । তাহলে কোনো পাপ তোমাকে স্পর্শ করতে পারবে না ।
৬. মানুষ শুধু তখনই আল্লাহর প্রিয় ও খাঁটি বান্দা হয়, যখন তার কাজ বা কথা আল্লাহর আদেশ ও নিষেধের উল্টো না হয় ।
৭. আল্লাহকে চিনতে ও জানতে হলে আল্লাহর পথে কঠোর সাধনা করতে হবে ।
৮. মানুষ যে পর্যন্ত দুনিয়াকে বাদ না দেবে, অর্থাৎ কর্তব্য কাজ ছাড়া অন্য কাজে মশগুল থাকবে, সে পর্যন্ত তার জন্য আল্লাহর প্রেমিক ও পরহিযগার হওয়া সম্ভব নয় ।
৯. আল্লাহ দুনিয়ার প্রত্যেকের রিযিকদাতা, তাঁর প্রতি যার বিশ্বাস ও ভরসা নেই, সে কী করে আল্লাহর ভালবাসা পাওয়ার আশা করে ?
১০. মনে রেখ যে, দুনিয়ায় প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ লোক মারা যাচ্ছে । তোমাকেও একদিন এ দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে যেতে হবে । মৃত্যু অনিবায্য।