ভারতের বিহার রাজ্যের এক গৃহবধূকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করেছিল তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকজন।
পুলিশ বলছে, হিন্দুদের মরদেহ যেভাবে সৎকার করা হয়, সেইভাবেই কাঠ দিয়ে চিতা সাজানো হচ্ছিল সারিকপুর ঘাটে।
স্থানীয়দের কাছ থেকে খবর পেয়ে পুলিশ যখন ঘটনাস্থলে পৌঁছে, তখন শুধু কাঠে আগুন দেওয়াটাই বাকি ছিল। চিতার ওপরেই অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন লক্ষ্মী দেবী।
ভোজপুর জেলার পুলিশ সুপারিন্টেনডেন্ট আদিত্য কুমার বিবিসিকে বলেন, “লক্ষ্মীদেবী নামের ওই নারীর বাপের বাড়ি থেকে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে যে বিয়ের বছর দশেক পরেও সন্তান না হওয়ায় তার শ্বশুরবাড়ির লোকজনরা নিয়মিত অত্যাচার করত। তারাই সোমবার জীবন্ত পুড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল।”
স্থানীয় সূত্র বলছে, বিয়ের এতদিন পরেও সন্তান না হওয়ার কারণে নিয়মিত অত্যাচার চলত ওই নারীর ওপরে।
স্বামী, শ্বশুর আর শাশুড়ি – তিনজনই মারধর করত ওই নারীকে।
সোমবারও তাকে মারধর করার পরে নদীর ঘাটে নিয়ে আসা হয়।
নদীর ঘাটে বালি তোলার কাজ করেন যে সব শ্রমিকরা, তাদের কাছ থেকে পুলিশ জানতে পেরেছে, ওই নারীকে ঘাটে নিয়ে আসার পরে খুব দ্রুত চিতা সাজানো হতে থাকে।
একসময়ে ওই নারীকে চিতার কাঠের ওপরে শুইয়েও দেওয়া হয়। তবে আগুন জ্বালানোর আগেই পুলিশ সেখানে গিয়ে অচেতন অবস্থায় ওই নারীকে উদ্ধার করে।
পুলিশ দেখেই অবশ্য ওই নারীর শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়রা পালিয়ে যায়। পুলিশ সুপারিন্টেনডেন্ট মি. কুমার বলছেন, “হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরে বাপের বাড়ির আত্মীয়রা এসে পুলিশে অভিযোগ দায়ের করেছে। অভিযুক্তরা সবাই পলাতক। তবে লক্ষ্মীদেবীর অবস্থা এখন স্থিতিশীল।”
পশ্চিমবঙ্গ মহিলা কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখার্জি বলছিলেন, “একদিকে ডিজিটাল ইন্ডিয়ার কথা বলা হচ্ছে, কন্যা সন্তানদের শিক্ষার কথা বলা হচ্ছে, অথচ নারী সুরক্ষার প্রাথমিক দিকগুলোর দিকে সরকারের নজর নেই। মেয়েদের জন্য অনেক আইন হয়েছে, অনেক প্রকল্প হয়েছে – কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়িত করার দায় না আছে সরকারের, না রাজনৈতিক দলগুলোর, না সমাজের।
মিসেস মুখার্জির আরও প্রশ্ন, “নারীদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য সচেতনতার দিকেই বা কতটা নজর দেওয়া হয়। বন্ধ্যা শব্দটাও তো এখনও নিষিদ্ধ হয় নি! কন্যা-ভ্রূণ আর কন্যা শিশু হত্যাও নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
যদিও লক্ষ্মীদেবীর স্বামী জীবিত রয়েছেন, এবং তিনিই অন্যতম অভিযুক্ত, তবে যেভাবে ওই নারীকে চিতা সাজিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল, তা অনেকটা প্রায় দুশো বছর আগে নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া সতীদাহ প্রথার মতোই।
ভারতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে স্বামীর মৃত্যুর পরে বধূকে সেই একই চিতায় জীবন্ত জ্বালিয়ে দেওয়ার প্রথা ছিল, যাকে সতীদাহ বলা হত।
মূলত উত্তর এবং পশ্চিম ভারতের হিন্দু যোদ্ধা আর রাজকীয় পরিবারগুলির মধ্যেই এই প্রথার চলন ছিল।
যদিও এই প্রথার কোনও ধর্মীয় অনুমোদন পাওয়া যায় না, যদিও রাজস্থানের বিভিন্ন অঞ্চলে এখনও প্রাচীন সতী দেবীর মন্দির রয়েছে।
ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে, বিশেষত বাংলায় সতীদাহ প্রথা ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়ে যায় পরবর্তী কালে।
অষ্টাদশ শতাব্দীর গোঁড়ায়, ১৮১৫ থেকে ১৮১৮ – এই ক’বছরের মধ্যে শুধু বাংলা প্রদেশেই আটশরও বেশী নারী সতী হয়েছিলেন বলে একটা হিসাব পাওয় যায়।
কিন্তু তারপরে খ্রিষ্টান ধর্মযাজক এবং রাজা রামমোহন রায়ের মতো কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির ক্রমাগত প্রচারণার ফলে ব্রিটিশ সরকার বাংলা প্রদেশে সতীদাহ নিষিদ্ধ করে।
পরে অন্যান্য দেশীয় রাজ্যে এবং সবশেষে ১৮৬১ সালে গোটা ভারতেই সতীদাহ নিষিদ্ধ হয়ে যায়।
তবে ১৯৮৭ সালে রাজস্থানেই রূপ কানোয়ার নামের এক ১৮ বছরের মেয়ে সতী হয়েছিলেন। একদিন আগে মারা যাওয়া তার স্বামীর চিতায় একই সঙ্গে মৃত্যু হয়েছিল তার।
ওই ঘটনায় সারা দেশে আলোড়ন পড়ে গিয়েছিল।
প্রাথমিক তদন্তে দুরকমের তথ্য উঠে এসেছিল – তিনি নিজেই চিতায় ঝাঁপ দিয়েছিলেন না কি তাঁকে জবরদস্তি চিতায় তোলা হয়েছিল, তা নিয়ে প্রাথমিকভাবে সন্দেহ তৈরি হয়েছিল।
পরে ১১জনকে অভিযুক্ত করে বিচার চলে। ২০০৪ সালে আদালত অবশ্য সকলকেই মুক্তি দেয়।
Array