
দেশের বিভিন্ন এলাকায় ফসলের মাঠেই হঠাৎ করে কৃষকের অসুস্থ হয়ে পড়ার ঘটনা বাড়ছে। জমিতেই কৃষক অসুস্থ হয়ে পড়ছেন ও তার দেহ অসাড় হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে জমিতে কীটনাশক ছিটানোর সময় অসুস্থ হয়ে পড়া ও প্রাণহানি ঘটছে। চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার মনপুরা গ্রামের কৃষক আবু সুফিয়ানের ২০ বছর বয়সের ছেলে কৃষক তারেক হোসেনের মৃত্যু হয় ২০১৯ সালে আকস্মিকভাবে। এমন মৃত্যুর আরও খবর পাওয়া যায় বগুড়া, পাবনা, জয়পুরহাট, টাঙ্গাইল ও কয়েকটি জেলা থেকে। কিন্তু এসব মৃত্যুর তেমন কোনো তদন্ত হয়নি। কী কারণে মানুষগুলো মারা গেলেন, তা গভীর তদন্ত করে খুঁজে বের করার তাগিদ দেখায়নি কেউ। চাঁদপুরে সুফিয়ানের মৃত্যুর দুই দিন পর পুলিশ গিয়েছিল মনপুরা গ্রামে।
বিশ্লেষকদের মতে, রোগের পেশাভিত্তিক কার্যকারণ নিয়ে বাংলাদেশে ফলিত গবেষণার ঘাটতি সব সময়ের সমস্যা। ক্যান্সারের ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে। কেন কৃষক বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন? আক্রান্ত কৃষকদের কোনো শ্রেণি বিভাজন আছে কি না। তাদের কৃষিচর্চায় কোনো রকমফের আছে কি না, তা নিয়ে গবেষণার অভাবে কেউ হলফ করে কিছু বলতে পারেন না।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় বলা হয়, কৃষি রাসায়নিকের যথাযথ নিবন্ধন না হওয়া, স্বীকৃত মাত্রায় সেগুলো ব্যবহার না করা, কীটনাশক ব্যবহারের সময় স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণে অনীহা, আন্তর্জাতিক নীতিমালার আলোকে জাতীয় পর্যায়ে এ সম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা না থাকা, তদারকির ঘাটতি, জাতীয় পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট ল্যাবরেটরি ও সক্ষমতা না থাকা প্রভৃতি বিষয়ে উদ্বেগ জানানো হয়।
বাংলাদেশের জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ক্যান্সার এপিডেমিওলজি বিভাগের প্রধান সম্প্রতি একটি সেমিনারে বলেছেন, দেশে ক্যান্সার রোগ নিয়ে বড় পরিসরে গবেষণা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে আরও গভীরে গিয়ে গবেষণা চালালে কোন পেশায় কী কারণে ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে, তা সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া যাবে।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, এখানে কৃষকের স্বার্থ আর স্বাস্থ্য নিয়ে কারও কোনো চিন্তা নেই। কৃষক যেন কেবলই উৎপাদন বাড়ানোর যন্ত্র। তার শ্বাস-স্বাস্থ্য কোনোটাই যেন বিবেচনার বিষয় নয়। এখানে কৃষক মরলে কেউ স্বপ্রণোদিত হন না। কৃষক গলায় ফাঁস নিলেও তাদের মাথা আকাশপানেই তোলা থাকে।
তথ্য উপাত্তে জানা যায়, বাংলাদেশের কৃষকদের বোকা বলে বকা দিয়ে কীটনাশক কোম্পানিগুলো তাদের যাত্রা শুরু করেছিল। সারা দেশে পোস্টার লাগিয়ে, ব্যানার টাঙিয়ে ও বিলবোর্ডে বিজ্ঞাপন দিয়ে তারা লিখে দিয়েছিল, ‘বোকার ফসল পোকায় খায়’। রেডিও-তথ্যচিত্র সর্বত্র ছিল সেই একই কথা, কৃষক তুমি বোকা, আর আমি বিষ বেচি, আমি চালাক। রাতারাতি চালাক হতে পারবে, যদি এই বিষ, ওই বিষ চটজলদি কিনে নাও।’ বালাই দমনে কৃষক সেভাবেই ঝুঁকেছিলেন বিষের দিকে। তবে এখন যেন বিষ ব্যবহারের মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে এখন বছরে ৫০ হাজার টনের বেশি কীটনাশক আমদানি হয়। ফসলে অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার ও তার অবশিষ্টাংশ (রেসিডিউ) বাজারে শাকসবজিতে থেকে যাওয়ার বিষয়টি একাধিক পরীক্ষায় উঠে এসেছে। যেমন ২০১৬ সালে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির এক পরীক্ষায় শীতকালীন সবজি ফুলকপিতে মানবদেহে সহনীয় মাত্রার ৩৬ গুণ বেশি কীটনাশক পাওয়া যায়। অতিব্যবহারের ফলে মানুষের শরীরে আগের অ্যান্টিবায়োটিক যেমন কাজ করছে না, তেমনি ফসল বাঁচাতে দিন দিন আরও উচ্চ মাত্রার বিষ লাগছে। সবজি এখন লাভজনক। অনেকেই সারা বছর সবজি চাষ করছেন। ফুল করছেন, চাষ বাড়ছে, কীটনাশকের চাহিদাও বাড়ছে। এতে জমি-কৃষক দুইই মরছে দুভাবে।
Array