বাংলাদেশের সিলেট বিভাগে মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলায় পৃথ্বীমপাশা নবাব বাড়ী। এই নবাব বাড়ীর মতো জীবন্ত নবাব বাড়ী বাংলাদেশে দ্বিতীয়টি নেই। একসময় এই অঞ্চলটি ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিলে।
মোগল সম্রাট আকবরের সময়কাল ইরান থেকে ধর্ম প্রচারের জন্য ভারতবর্ষে আসেন শিয়া মতবাদি সাকি সালামত খান, তাঁহার ছেলে ইসমাইল খান পৃথ্বীমপাশায় এসে ধর্ম প্রচার করেন। এখানেই তাঁহার নামে একটি দিঘির নাম করন করা হয়।
ইসমাইল খানের ছেলে শামসুদ্দিন খান তাঁহার ছেলে রবি খান। রবি খানের নামে ” রবির বাজার হাট ” নামে একটি বাজারের নামকরণ করা কয়েছে। রবি খানের ছেলে মোহাম্মদ আলী খান সিলেটের কাজী ( বিচারক ) ছিলেন। সে-সময় পাহার বেষ্টিত এই অঞ্চলটিতে নওগা কুকি উপজাতির বেশ প্রতাপ ছিলো। তাহারা ততকালীন বিট্রিশ সরকারের কোন আইনই মেনে নিতোনা। ব্রিটিশ সরকার এই কুকি উপজাতিদের বিদ্রোহ দমন করতে এলে মোহাম্মদ আলী খান ব্রিটিশ সরকারে পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
ইংরেজ সরকার এতে খুশি হয়ে মোহাম্মদ আলীর পুত্র গাওস আলী খাঁনকে ১২০০ হাল (১৪৪০০ ) বিঘা জমি দান করেন। তখন থেকেই এখানে জমিদারি প্রতিষ্ঠিত হয়। জমিদার গনের নির্মিত প্রাসাদ, শিয়া সম্প্রদায়ের একটি চমৎকার নকশা খচিত ইমামবাড়া, মসজিদ, শান বাধানো ঘাট সহ সুবিশাল দীঘি, দীঘির দুপাড়ে দুইটি মাজার একটি হাজি খাঁ। আপরটি শাহ্ ডিঙ্গির মাজার রয়েছে।
১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের সময় চট্টগ্রাম থেকে হাবিলদার রজব আলীর নেতৃত্বে একদল ইংরেজ বিদ্রোহী সৈন্য সিলেটে আগমন করেন এবং গাওস আলী খাঁর সাহায্য, সমর্থন চান। গাওস আলী খাঁন গোপনে বিদ্রোহী সৈন্যদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। যুদ্ধ শেষে গাওস আলী খানকে বিদ্রোহে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়।
ইংরেজ সরকার শত চেষ্টা করেও কোন প্রমাণ না পেয়ে গাওস আলী খাঁনকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। উত্তরাধিকার সূত্রে জমিদারীর মালিক হন আলী আহমদ খান। জমিদার আলী আহমদ খানের সময় কালে জমিদারির আয় ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। তিনি বৃটিশ সরকারের আনুকুল্যে লাভ করেন।
তিনি প্রজা কল্যানে অনেক জনহিতকর কাজ করেন। তাহার সময় সুরমা নদীর তীরে চাঁদনীঘাট এবং আধুনিক সিলেট শহরের গোড়াপত্তন হয়। তিনি অনেক রাস্তা, মসজিদ, মাদ্রাসা, দীঘি, পুকুর, খনন করেন।
গভর্নর জেনারেল নর্থ ব্রুক এর সিলেট আগমন উপলক্ষে সিলেট শহরকে অত্যান্ত সুন্দর ভাবে সাজিয়ে তোলার লক্ষে ১৮৭৪ সালে ছেলে আলী আমজাদ খাঁন এর নামে কিন ব্রিজের ডানে সুরমা নদীর তীরে একটি ক্লক টাওয়ার স্থাপন করেন। যাহা আলী আমজাদ খাঁন এর ঘড়ি নামে বিখ্যাত।
আলী আমজাদ খাঁনের জন্ম ১৮৭১ সালে। পিতার মৃত্যুর পর পুত্র আলী আমজাদ খাঁন জমিদারির দ্বায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি অত্যান্ত প্রজা হিতকর ছিলেন। নারী শিক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্তাসহ বিভিন্ন উন্নয়ন মূলক কর্মকাণ্ড ইতিহাস হয়ে আছে।
১৯০৫ সালে মৌলভীবাজার আলী আমজাদ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় এবং পৃথ্বীমপাশা বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি জনকল্যাণমুখী কাজের জন্য ব্রিটিশ সরকার তাহাঁকে নবাব খেতাবে ভূষিত করেন। তিনি মাত্র ৩৪ বৎসর বয়সে ১৯০৫ সালের শেষের দিকে ইন্তেকাল করেন।
তাঁহার সুযোগ্য পুত্র আলী হায়দার খান ব্রিটিশ ভারতে বঙ্গ আসাম প্রাদেশিক সরকারের কৃষি মন্ত্রী ছিলেন। তিনি বৃটিশ সরকার বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন। আলী হায়দার খানের দুই পুত্র যথা আলী সফদর খান( রাজা সাহেব ) ও আলী সারওয়ার খান ( চুন্নু নবাব ) আলী সফদর খান বাম প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা ছিলেন এবং মওলানা ভাসানী অত্যান্ত বিশ্বস্ত অনুসারী ছিলেন। আরেক ভাই আলী সারওয়ার খান আওয়ামী লীগ করতেন ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগ প্রার্থী হয়ে বিজয়ী হন এবং ১৯৭৩ সালে উপনির্বাচনে কুলাউড়া আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
আলী সফদর খান রাজা সাহেবের সুযোগ্য সন্তান নবাব আলী আব্বাস খান ১৯৫৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর পৃথ্বীমপাশা নবাব বাড়ী জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আইন শাস্ত্রে পড়ালেখা শেষ করে আইন পেশায় কর্মরত থাকার পাশাপাশি রাজনীতিতে প্রবেশ করেন, ব্যক্তি জীবনে তিনি অত্যান্ত ভদ্র, বিনয়ী, সৎ, জন কল্যানকর মানুষ। তিনি জাতীয় পার্টিথেকে নমিনেশন পেয়ে মৌলভীবাজার ২ কুলাউড়া আসনে ১৯৮৮, ১৯৯১, ও ২০০৮ সালে সাংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি বেশীর ভাগ সময় এলাকায় থাকেন। এলাকায় থেকে মানুষের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা নিয়ে জনকল্যাণমুখী কাজ করে যাচ্ছেন। বর্তমানে নবাব আলী আব্বাস এই নবাব ষ্টেটের মোতোয়ালি।
তাহাঁর তিন ছেলে আলী হাসিব খান, আলী সাকিব খান, আলী আরিফ খান। এই নবাব বাড়ীতে অনেক নামি-দামি মানুষের আগমন ঘটেছে। ব্রিটিশ সরকারের গভর্নর জেনারেল নর্থ ব্রুক, ত্রিপুরার মহারাজা রাধা কিশোর মানিক্য বাহাদুর, ১৯৫১ সালে ইরানের সম্রাট রেজা শাহ্ পাহলভী, ফীল মার্শাল মোহাম্মদ আউয়ুব খান, ২০০৬ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ, সাবেক প্রধান মন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদ সহ আরো অনেকে এই নবাব বাড়ীর আতিথেয়তা গ্রহণ করেন।।
Array